বাঙালি এই তালিকায় আরও একটি পদ যুগিয়েছে। অন্যতম প্রিয় সুখাদ্য পান্তা ভাত বললে, কেউ ভ্রু কুচকে তাকাবে না। আরেকটি বিষয়, এই খাবারগুলির রয়েছে খুব মিল, যাকে বলে উচ্চকিত স্বাদ-গন্ধ বিশিষ্ট। তেজালো ঝাঁজ না হলে কি পান্তার সাথে তরকারি জমে?
পিৎজার যেমন নানাবিধ গন্ধযুক্ত চিজের সমারোহ, ঠিক তেমনই এক একটি এলাকায় তৈরি সসেজ বা নাগেটস ছাড়া তার আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য বোঝার উপায়ও নেই। এদিকে পান্তার ক্ষেত্রে বাঙালি অনেক বেশি সূক্ষ্ম কারুকাজ পছন্দ করে। গরিবের রোজগার পান্তার সাথে বড়লোকের পালাপার্বণের আহারটিকে বাহারি করাতেও পার্থক্যগুলি যেন চোখে পড়ার জন্যই তৈরি করা হয়। পহেলা বৈশাখে শহুরে রাস্তাগুলোয় মানুষের ঢল নামে। নতুন বছরের প্রথম দিনটাকে যতটা যত্ন সহকারে, রাস্তায় আলপনা এঁকে, নিজেদের সাজিয়ে-গুঁজিয়ে, গান গেয়ে ও আবৃত্তি মারফতে পালন করা হয়। ঠিক তেমনিভাবেই খাদ্য তালিকাটির গোঁড়ায় পান্তা-ইলিশ যোগ করে দেশের মানুষের ঐতিহ্য রক্ষায় ততটাই যত্নবান তারা। এছাড়া পান্তা খাওয়ারও নির্দিষ্ট একটি সময় আছে। উৎসবে যা নড়চড় হবার জোঁ নেই।
এছাড়া বাংলায় ৯ মাসই থাকে গরম। তাই আগের-দিনের বাড়তি খাবার নষ্ট না করার জন্য যেমন পানি দিয়ে রাখা জরুরি, তেমনি ভোরে ওঠে ভাত রাঁধার বদলে, আগের-দিন তা করে রাখাটাই যেন সহজ উপায়। এদিকে পান্তার সঙ্গে চাষিদের ভোরে মাঠে খাটতে যাওয়ার যোগটি কিন্তু বেশ পুরনো। কথায় আছে, ‘পান্তা ভাতের ফল, তিন পুরুষের বল।’ বাংলার গ্রাম অঞ্চলে আগে কৃষকরা খুব সকালে লাঙ্গল কাঁধে নিয়ে মাঠে যাওয়ার ২-৩ ঘণ্টা পর সকালের নাশতা হিসেবে পান্তাভাত খেত। এ ভাত তাদের তাৎক্ষণিক শক্তি জোগাত এবং দ্বিগুণ উৎসাহে তারা কাজে নিয়োজিত হতো। কিন্তু কেউ কোনও দিন পরীক্ষা করে দেখেনি যে পান্তাভাতে কি গুণাগুণ বিদ্যমান।এতদিন এ রহস্য যেন অজানাই ছিল,বিজ্ঞানের কল্যাণে তা আজ প্রমাণিত। পান্তাভাত যদি সঠিকভাবে খাওয়া যায় তাহলে সাধারণ মানুষের আয়রনের অভাব বা রক্তশূন্যতা থাকবে না এবং ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়ামের অভাব অনেকাংশে দূরীভূত হবে, আর মানুষ শারীরিকভাবে সুস্থ থাকবে।
এদিকে দেশজুড়ে রুটি খাওয়ার প্রচলন হালে। তাছাড়া নাস্তায় চাল থেকে তৈরি খাদ্য জুটানো সহজ ও সস্তা । সকালে লবণ, মরিচ,পেঁয়াজ, দিয়ে হুশহাশ শব্দে যেমন খুব সহজেই একথালা পান্তা উড়িয়ে দেয়া যায়, তেমনি শুটকি মাছের ভর্তা, ডিম ভাজা,বাসি ঝোল তেল মশলার তরকারি, নানা প্রকার ভাজা আচারও তার সাথে যায় ভাল।
সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার মাস্টার শেফ অনুষ্ঠানে পান্তার, আন্তর্জাতিকভাবে জয়জয়কার। সেখানে বাসমতী চালের পান্তার সাথে অবশ্য বাঙালিয়ানা ততটা খাপ খায় না, যতটা ঢেকিছাঁটা লাল চালের সাথে খায়। সারারাত পানিতে ভিজিয়ে লাল চালের উপরটা একটু ফেটে যাবে। আমানি অর্থাৎ পানি ভেজা ভাতে একটু টকসামিষ্টি স্বাদ ভরবে। এছাড়া সবার ইলিশ জোটানোর সামর্থ্য না থাকলেও অসুবিধে নেই! অন্য অনেক তরকারি পান্তা খাওয়ার সমান রোমাঞ্চকর।
পান্তার সাথে একাধিক লাইফ-স্টাইল বা জীবনবোধ জড়িত বলে, কোনও একটাকে অনুসরণ করা সহজ হয় পেট ঠাণ্ডা থাকলে। আলুভর্তা, শুটকি-ভর্তা, কুমড়ো ফুল কিংবা কুমড়ো শাক-ভাজা যেমন পান্তার সাথে জড়িয়ে আছে, তেমনি পান্তা হয়তো সত্যি গিলতে হয়। হাত থেকে প্রতি গ্রাসে ফোটায় ফোটায় টপটপ করে তেল-ঝোল পানি ঝড়ে পড়বে। কাঁচামরিচ দাঁতে কাটার সময় কটাস কটাস করে আওয়াজ হবে। এছাড়াও শুকনো মরিচ সাথে ডলে নেয়ার ফলে নাক ও চোখ দিয়ে পানি পড়বে। শরীরের কতটুকু কার্বোহাইড্রেট ঢুকলো, তার চিন্তায় মাথার চুল সাদা হবেনা, তাতেই পান্তা খাওয়ার সুখ! তারপর নাক ডেকে ঘুম।
পান্তা খাওয়ার এই সুখ চিরজীবী হোক!
সংবাদচিত্র/লাইফ স্টাইল