স্বাধীনতার পর থেকে নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশের সিনেমা হলে মুক্তি পায়নি হিন্দি সিনেমা। দীর্ঘ জল্পনা-কল্পনা শেষে আট বছর পর প্রথমবার দেশের সিনেমা হলে মুক্তি পেলো কোনো বলিউড চলচ্চিত্র। সেটিও আবার বিশ্ব জুড়ে কোটি হৃদয়ের প্রিয় তারকা শাহরুখ খানের।
সিনেমা শুরু হওয়ার আরো ঘণ্টাখানেক সময় বাকি তখনো। হল প্রাঙ্গণে এরই মধ্যে জড়ো হয়েছেন শাহরুখপ্রেমীরা। সিনেমার পোস্টার আর বলিউড বাদশার কাট-আউটের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার সিরিয়াল পেতে লাইন দিতে হচ্ছে রীতিমতো। শাহরুখের ছবি আর সিনেমার ডায়লগ ছাপানো টি-শার্ট পরে দল বেঁধে এসেছেন অনেকেই। ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে হই-হুল্লোড় চলছে তাদের। উত্তেজনার পারদ ক্রমেই উঁচুতে উঠছে।
১২ মে শুক্রবার ঢাকার বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সের স্টার সিনেপ্লেক্সে সকাল থেকে শুরু করে সারাদিনই ছিল এই উৎসবমুখর দৃশ্য। উপলক্ষ- শাহরুখ খান, দীপিকা পাডুকোন, জন আব্রাহাম অভিনীত সিনেমা ‘পাঠান’-এর মুক্তি।
স্বাধীনতার পর থেকে নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশের সিনেমা হলে মুক্তি পায়নি খুব বেশি হিন্দি সিনেমা। দীর্ঘ জল্পনা-কল্পনা শেষে আট বছর পর প্রথমবার দেশের সিনেমা হলে মুক্তি পেলো কোনো বলিউড চলচ্চিত্র। সেটিও আবার বিশ্ব জুড়ে কোটি হৃদয়ের প্রিয় তারকা শাহরুখ খানের। স্বাভাবিকভাবেই সিনেমাটিকে ঘিরে ভক্তদের আনন্দ-উত্তেজনা কোনো উৎসবের চেয়ে কম নয়। যার প্রতিফলন দেখা গিয়েছে দেশের সিনেমা হলে।
‘ট্রু এসআরকেআনস বিডি’ গ্রুপের ব্যানার নিয়ে ৫০ জন শাহরুখভক্ত এসেছেন পাঠানের ‘ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো’ দেখতে। শাহরুখের ছবি-ডায়লগসহ টি-শার্ট তাদের প্রত্যেকের গায়ে। গ্রুপের সদস্য আসিফ জানান, কর্মসূত্রে দুবাই থাকেন তিনি। সিনেমাটি মুক্তির পরপরই সেখানকার হলে গিয়ে দেখা হয়েছে তার। তবুও দেশে এসে শাহরুখভক্তদের সঙ্গে দলবেঁধে পাঠান দেখার লোভ সামলাতে পারেননি। এটি তার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা।
‘শাহরুখ খান ইউনিভার্স বাংলাদেশ’ গ্রুপের আয়োজনে আরো ১০০ জন শাহরুখ ভক্ত দলবেঁধে এসেছেন পাঠানের প্রথম শো দেখতে। তাদের পরনেও পাঠান লেখা টি-শার্ট। দলটির সংগঠক ফারহান ফাহিদুর রহিম বলেন, “দেশের নানা প্রান্ত থেকে একসঙ্গে পাঠান দেখতে এসেছেন শাহরুখ ফ্যানরা। এখানে এমনও মানুষ আছেন যারা প্রথমবার ঢাকায় এলেন শুধু শাহরুখ খানের সিনেমা হলে বসে দেখবেন বলে। ওটিটি প্লাটফর্মে ছবিটি চলে আসায় অনেকের আগেই দেখা আছে পাঠান। তবুও হলে বসে প্রিয় নায়কের সিনেমা দেখার আমেজই অন্যরকম।”
পাঠানের গানে শাহরুখের ‘লুক’ অনুকরণ করে পোশাক পরে এসেছিলেন পুরান ঢাকার ভক্ত শাওন। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে শাহরুখ খানের ‘ডাই হার্ড ফ্যান’ তিনি। এবারই প্রথমবার সুযোগ পেলেন হলে বসে প্রিয় তারকার সিনেমা দেখার। তাই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে সিনেমার ‘বেশরম রঙ’ গানে শাহরুখের পরা একই প্রিন্টের শার্ট বানিয়ে পরে এসেছেন তিনি।
সিনেমা হলের বাইরের এই উৎসবমুখর পরিবেশ বজায় ছিল হলের ভেতরেও। ২ ঘণ্টা ২৬ মিনিটের সিনেমাটিতে পুরো সময় দর্শকদের উল্লাসধ্বনি আর হাততালিই প্রমাণ করছিল তাদের উৎসাহ। শেষ দৃশ্যের গানের তালে নাচতে শুরু করেন ভক্তরা। তবে সিনেমা দেখার পাশাপাশি দর্শকদের ধারাভাষ্য শুনে বোঝা যাচ্ছিলো অন্তত ৯০ শতাংশ দর্শকই সিনেমাটি একাধিকবার দেখেছেন আগে।
সিনেমা শেষে বেরোনোর পর কথা হয় পঞ্চগড় থেকে আসা তরুণী মাইশার সঙ্গে। তিনি বলেন, “ছোটবেলা থেকেই আমি শাহরুখ খানের ফ্যান। আমার ঘর জুড়ে তার পোস্টার। ওম শান্তি ওম যখন রিলিজ হয় তখন ক্লাস ফোরে পড়তাম। অনেক দর্শকের সঙ্গে বসে বড় পর্দায় শাহরুখের সিনেমা দেখার স্বপ্নের শুরু তখন থেকেই। অবশেষে তা পূরণ হলো। এর আগে অলরেডি দুইবার দেখেছি পাঠান। একবার হল প্রিন্ট ডাউনলোড করে, আরেকবার ওটিটিতে। তবু এবার দেখার অনুভূতি সবচেয়ে অন্যরকম। হলের স্ক্রিনে শাহরুখকে দেখে আমার স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছিল!”
আরেক ভক্ত সোহান বলেন, “সিনেমা হলে বসে সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা আমার অনেক দিনের। কিন্তু আজকের মতো এনজয় আগে কখনো করিনি। হাউজফুল হলে বসে বলিউডের সিনেমা দেখার আমেজটাই অন্যরকম। বাংলাদেশে যদি পাঠানের সমমানের অল্প কিছু সিনেমাও তৈরি হত তাহলে দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিই বদলে যেত। এত এত হলও আর বন্ধ হত না।”
কথা হয় হলে কর্মরত কাস্টমার কেয়ার অফিসার হৃদয়ের সঙ্গে। তিনি জানান, এত স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দমুখর পরিবেশ আগে কখনো দেখেননি হলে। ঈদে মুক্তি পাওয়া বাংলা সিনেমা বা জনপ্রিয় ইংরেজি সিনেমাগুলোতে অনেক দর্শক হলেও এমন উৎসবের আমেজ হয় না তখনো।
ভারতসহ বিশ্বের একাধিক দেশে গত ২৫ জানুয়ারি মুক্তি পেয়েছে যশ রাজ ফিল্মসের স্পাই ইউনিভার্সের এই ছবি। সেসময়ই বাংলাদেশে সিনেমাটি মুক্তির কথা উঠলেও নানা বিতর্কে বারবার পিছিয়েছে তারিখ। এ দেশে সিনেমাটির আমদানিকারক অনন্য মামুনের প্রতিষ্ঠাবন অ্যাকশন কাট এন্টারটেইনমেন্ট। প্রথম সপ্তাহে দেশজুড়ে ৩২টি সিঙ্গেল স্ক্রিন ও ৯টি মাল্টিপ্লেক্সে মুক্তি পেয়েছে পাঠান। প্রতিদিন শো চলছে ২০৬টি।
অনন্য মামুন বলেন, “টিকিট বিক্রি শুরু হওয়ার পর থেকেই আমরা অভূতপূর্ব সাড়া পাচ্ছি। পরবর্তী ঈদের আগ পর্যন্তই পাঠান নিয়ে দর্শকদের আগ্রহ বজায় থাকবে বলে মনে হয় আমার।”
স্টার সিনেপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ বিপণন কর্মকর্তা মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ জানান, দেশজুড়ে তাদের সাতটি শাখায় মোট ৩৪টি শো চলছে পাঠানের। এরমধ্যেই প্রথম দুইদিনের সবগুলো শো-এর টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। আশা করছেন পুরো সপ্তাহজুড়েই উত্তাপ ছড়াবে পাঠান।
তবে মাল্টিপ্লেক্সগুলোর মতো জমজমাট পরিবেশ নেই সিঙ্গেল স্ক্রিনের সিনেমা হলগুলোতে। বাংলাদেশ হল মালিক সমিতির সভাপতি মিয়া আলাউদ্দিন বলেন, “দেশের সবগুলো সিনেপ্লেক্সেই মোটামুটি হাউজফুল যাচ্ছে পাঠান। কিন্তু সিঙ্গেল স্ক্রিন একটাতেও এখনো হাউজফুলের খবর পাইনি। এমনকি ঢাকার বিখ্যাত সিনেমা হল মধুমিতাতেও না। এর পেছনে অবশ্য অনেকগুলো কারণ আছে।”
“প্রথমত, সারা বিশ্বে পাঠান মুক্তি পাওয়ার প্রায় সাড়ে তিন মাস পর বাংলাদেশে এসেছে। বারবার সিনেমাটির মুক্তি পেছানোর কারণে দেশজুড়ে ঠিকমতো প্রচারও করা হয়নি। তাছাড়া, এরকম সিনেমা চালানোর মতো ভালো স্ক্রিন বা সাউন্ড কোয়ালিটি নেই বেশিরভাগ সিঙ্গেল স্ক্রিনের হলেই। দেশীয় সিনেমার তুলনায় বিদেশি সিনেমার টিকিটের মূল্যও বেশি। তাই অতিরিক্ত টাকা খরচ করে দর্শক এসব হলে সিনেমা দেখার চেয়ে সিনেপ্লেক্সে যাওয়াই ভালো মনে করবে। সাফটা চুক্তি অনুযায়ী সিনেমা হলের ব্যবসায় লাভবান হতে হলে সিঙ্গেল স্ক্রিনের হলগুলোর আধুনিকায়ন জরুরী,” যোগ করেন তিনি।
সংবাদচিত্র ডটকম/সিনেমা