দেশের গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। সড়ক, সেতু, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাজার অবকাঠামো থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ ও স্যানিটেশন—প্রত্যন্ত অঞ্চলের উন্নয়নে এ সংস্থার অবদান অনন্য। অথচ আজ নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও প্রমোশন জটে কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
শীর্ষ পদ শূন্য, মাঠপর্যায়ে অতিরিক্ত চাপ
অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী ও সহকারী প্রকৌশলী—সব স্তরেই ভয়াবহ পদোন্নতি সংকট। ১৩টি অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর পদের বিপরীতে এখন কর্মরত আছেন মাত্র ৪ জন। বছরের শেষে সংখ্যা নেমে আসবে একজনের কোটায়।
মাঠপর্যায়ে দুই শতাধিক উপজেলা প্রকৌশলী অতিরিক্ত দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। সদর দপ্তরে একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে ২–৩টি দফতরের দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। ফলে প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়নে গতি কমে আসছে।
উন্নয়ন কার্যক্রমে প্রভাব
গ্রামীণ সড়ক, স্কুল-কলেজ ভবন, সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ—এলজিইডির প্রতিটি প্রকল্প বিলম্বিত হচ্ছে কর্মকর্তা সংকটে। অনেক এলাকায় নতুন সড়ক নির্মাণ ও পুরোনো সড়ক সংস্কার কাজ সময়মতো শেষ হচ্ছে না, ভোগান্তি পোহাচ্ছে সাধারণ মানুষ।
ভেতরের দ্বন্দ্বে তিন গ্রুপ
সূত্র জানায়, সহকারী প্রকৌশলী থেকে নির্বাহী প্রকৌশলী পদোন্নতি নিয়ে এলজিইডি ভেতরে তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।
🔹 ২৫৭ জনের গ্রুপ
এরা ছিলেন চুক্তিভিত্তিক বা অস্থায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত প্রকৌশলী। দীর্ঘদিন চাকরিতে থাকার পর তাঁদের নিয়মিতকরণ ও পদোন্নতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
২০২২ সালের ১৬ অক্টোবর প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল রায় দেয়— তাদের পদোন্নতি ও জ্যেষ্ঠতা বৈধ। তবুও মামলাজটের কারণে এখনো প্রমোশন কার্যকর হয়নি।
এই গ্রুপে অনেকেই ২৭–২৮ বছর ধরে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবেই আটকে আছেন।
🔹 জামাল গ্রুপ
২০১৩ সালে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (PSC) এর মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রকৌশলীরা এই গ্রুপে আছেন।
PSC পরীক্ষা দিয়ে আসায় তাঁরা নিজেদের যোগ্যতায় নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা দাবি করেন।
আদালতের রায় মেনে নেওয়ার পরও তাঁরা আবার নতুন মামলা করে, যাতে ২৫৭ জনের প্রমোশন আটকে যায়।
🔹 ২০০৫ গ্রুপ
এরা মূলত ২০০৫ সালে নিয়োগ পাওয়া প্রকৌশলীদের একটি অংশ।
অভিযোগ আছে, এরা নানা সময়ে প্রমোশনে প্রভাব বিস্তার করে এসেছে। চলমান দ্বন্দ্বেও নিজেদের অবস্থান শক্ত রাখতে কাজ করছে এই গ্রুপ।
আদালতের রায় ও প্রশাসনিক জট
২৫৭ কর্মকর্তার প্রমোশন বৈধ ঘোষণা করে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল ২০২২ সালের ১৬ অক্টোবর রায় দেয়। তাতে বলা হয়—তাদের পদায়ন ও পদোন্নতি বৈধ এবং ২০১৫ সালের জ্যেষ্ঠতা তালিকাও সঠিক। কিন্তু জামাল গ্রুপ আবার নতুন মামলা করে, যা বর্তমানে উচ্চ আদালতে চলমান।
মানবিক ক্ষতি ও হতাশা
২৫৭ জন কর্মকর্তার মধ্যে ইতোমধ্যে কেউ মারা গেছেন, কেউ অবসরে গেছেন, কেউ চাকরি ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। বর্তমানে ওই গ্রুপে চাকরিতে আছেন মাত্র ১৮৫ জন।
এলজিইডির একাধিক কর্মকর্তা বলেন—“চাকরিজীবীর বড় প্রত্যাশা থাকে পদোন্নতি। কিন্তু এখানে সেটা বছরের পর বছর আটকে আছে। এটি হতাশাজনক। সব বিভেদ ভুলে সংস্থার স্বার্থে দ্রুত এ জটিলতা সুরাহা করা প্রয়োজন।”
অতীতের সাফল্য বনাম বর্তমান অচলাবস্থা
স্বাধীনতার পর থেকে গ্রামীণ উন্নয়ন ও অবকাঠামো নির্মাণে এলজিইডির অবদান অনন্য। দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও সড়ক, সেতু, বিদ্যালয় ভবন পৌঁছে দেওয়ার কৃতিত্ব এ সংস্থার। কিন্তু এখন সেই ধারাবাহিকতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রশাসনিক জটিলতা ও প্রমোশন সংকটে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দ্রুত সমাধান না হলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন কার্যক্রমেই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সংবাদচিত্র ডটকম/জাতীয়