বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহে ফের ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের ২৪ দিনে (১ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি) ১৩৩ কোটি ৮ লাখ ৬০ হাজার ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। প্রতিদিন গড়ে এসেছে ৫ কোটি ৫৪ লাখ ডলার।
রেমিট্যান্সে প্রতি ডলারের জন্য ১০৭ টাকা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। এ হিসাবে টাকার অঙ্কে এই ২৪ দিনে ১৪ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা দেশে পাঠিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী সোয়া কোটি প্রবাসী, প্রতিদিন পাঠিয়েছেন ৫৯৩ কোটি টাকা।
সব মিলিয়ে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭ মাস ২৪ দিনে (২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি) ১ হাজার ৩৭৮ কোটি ২৯ লাখ ডলার এসেছে। নতুন বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে প্রায় ২০০ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা ছিল গত পাঁচ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। গত বছরের জানুয়ারির চেয়ে বেশি এসেছে প্রায় ১৫ শতাংশ। আর আগের মাস ডিসেম্বরের চেয়ে ১৫ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংক রবিবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) রেমিট্যান্স প্রবাহের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, ২০২৩ সালের দ্বিতীয় মাস ফেব্রুয়ারির প্রথম ২৪ দিনে যে ১৩৩ কোটি ৮ লাখ ডলার দেশে এসেছে, তার মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ২২ কোটি ১৫ লাখ ডলার। বিশেষায়িত কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ২ কোটি ৯৮ লাখ ৬০ হাজার ডলার। ৪২টি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ১০৭ কোটি ৪৩ লাখ ডলার। আর ৯টি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৫১ লাখ ৮০ লাখ ডলার।
জানুয়ারিতে ১৯৬ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে। গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে প্রবাসীরা ১৭০ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন। অক্টোবর ও নভেম্বরে এসেছিল যথাক্রমে ১৫২ কোটি ৫৫ লাখ ও ১৫৯ কোটি ৫২ লাখ ডলার। সেপ্টেম্বরে এসেছিল ১৫৪ কোটি ডলার। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাস জুলাই ও আগস্টে অবশ্য ২০০ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল।
মার্চের শেষ দিকে রমজান মাস শুরু হবে। রোজা ও ঈদ সামনে রেখে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও বাড়বে বলে আশা করছিলেন জনশক্তি রপ্তানিকারক, ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেছিলেন, ব্যাংকের চেয়ে খোলাবাজারে ডলারের দাম বেশি হওয়ায় এবং বেশি টাকা পাওয়ায় মাঝে কয়েক মাস প্রবাসীরা অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে দেশে অর্থ পাঠানোয় ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমে গিয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক হুন্ডির বিরুদ্ধে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়ায় ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়তে শুরু করেছিল।
কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে রেমিট্যান্স প্রবাহ ফের কমে যাওয়ায় সরকারের নীতিনির্ধারকদের কপালে ভাঁজ পড়েছে। ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিনে। ২৪ দিনে যে রেমিট্যান্স এসেছে, মাসের বাকি চার দিনে (২৫ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি) সেই হারে আসলে মাস শেষে ১৫০ কোটি ডলারের কিছু বেশি আসবে। যা হবে ছয় মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম।
রিজার্ভ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার বিক্রি
এদিকে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রিতে নতুন রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অস্থির ডলারের বাজার সুস্থির করতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (২০২২ সালে ১ জুলাই থেকে ২৬ফেব্রুয়ারি) প্রায় ১ হাজার (১০ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এর আগে কোনো অর্থবছরের (১২ মাস) পুরো সময়েও রিজার্ভ থেকে এত ডলার বিক্রি করা হয়নি।
এর ফলে রপ্তানি আয় এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বহুলপ্রতীক্ষিত ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার পাওয়ার পরও বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এই সূচক কমছেই। রোববার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩২ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার।
এক বছর আগে গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৫ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) নভেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদের ১ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ কমে ৩২ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। তার আগে ছিল প্রায় ৩৪ বিলিয়ন ডলার।
মার্চের প্রথম সপ্তাহে আকুর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। সেই বিল ১ বিলিয়ন ডলার হলেও রিজার্ভ কমে ৩০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসবে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
অথচ গত ২০২১-২২ অর্থবছরের পুরো সময়ে রিজার্ভ থেকে ৭৬২ কোটি ডলার বিক্রি করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তার আগের অর্থবছরে (২০২০-২১) ডলারের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় বাজার থেকে উল্টো প্রায় ৮০০ কোটি ডলার কিনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ যে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল, তাতে বাজার থেকে ডলার কেনার অবদান ছিল। আবার এখন যে রিজার্ভ কমছে, তাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি একটি বড় কারণ বলে মনে করছেন এই অর্থনীতিবিদ ব্যাংকাররা।
করোনা মহামারি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশে আমদানি বাড়তে শুরু করে; লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে অর্থনীতির এই সূচক। তাতে বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়, বাড়তে থাকে দাম। সেই চাহিদা মেটাতে ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
২০২১-২২ অর্থবছরের পুরো সময় ধরে চলে এই বিক্রি। রিজার্ভ থেকে ডলার বাজারে না ছাড়লে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম আরও বেড়ে যাবে- এ বিবেচনায় ডলার বিক্রি অব্যাহত রাখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শেষ পর্যন্ত ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রির মধ্য দিয়ে অর্থবছর শেষ হয়।
গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরেও রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগে সব ব্যাংকের কাছে প্রয়োজনীয় ডলার বিক্রি করলেও চার মাস ধরে শুধু সরকারি কেনাকাটা ও জ্বালানি তেল, সারসহ অন্যান্য অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির জন্য এলসি বা ঋণপত্র খুলতে রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের কাছে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে। বর্তমানে ১০১ টাকা দরে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলো আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ডলার কিনে আমদানি খরচ মেটাচ্ছে। রবিবার আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ১০৭ টাকা। অর্থাৎ যে ব্যাংকের ডলার প্রয়োজন হয়েছে, সে ব্যাংকগুলো ১০৭ টাকা দরে অন্য ব্যাংক থেকে ডলার কিনে চাহিদা মিটিয়েছে।
সংবাদচিত্র ডটকম/বিশেষ সংবাদ