উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন একটি দীর্ঘস্থায়ী অসুখ যাতে রোগীর রক্তচাপের মাত্রা বেশিরভাগ সময়ে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়। যে কোন তরলের মতো রক্তও প্রবাহমান অবস্থায় রক্তনালীর দেয়ালে বল বা চাপ প্রয়োগ করে। এটি mmHg বা পারদের মিলিমিটারে পরিমাপ করা হয়।
ব্লাড প্রেশার বললে আমরা দুটি মান বোঝাই।
একটি হলো- সিস্টোলিক চাপ (যেটা বেশি) আর অন্যটি ডায়াস্টোলিক চাপ (যেটা কম)।
প্রাপ্তবয়স্ক লোকের ক্ষেত্রে 140/90 mmHg বা তার বেশি রক্তচাপকে সাধারণত উচ্চ রক্তচাপ বলে মনে করা হয়।
উচ্চ রক্তচাপ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রোগ। বিশ্বের কোন ব্যক্তিই যেমন এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে, তেমনি আক্রান্ত রোগীর দেহের সব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গই এই উচ্চ রক্তচাপের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এটি শরীরের ধমনী ও ক্ষুদ্র কৈশিকনালীতে ক্ষতি করতে পারে। ফলে হৃদপিন্ড, মস্তিষ্ক, কিডনি এবং চোখসহ অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের উপর চাপ সৃষ্টি হতে পারে। যদি সঠিকভাবে ও সময়মতো এই উচ্চ চাপ নিয়ন্ত্রন করা না হয়, তবে এটি হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনি ফেইলিউর এবং দৃষ্টিশক্তি হ্রাস সহ গুরুতর জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপের দুটি প্রধান প্রকার রয়েছে: প্রাইমারি বা এসেনশিয়াল হাইপারটেনশন এবং সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন। শতকরা ৯০-৯৫% উচ্চ রক্তচাপের রোগীরা প্রাইমারি হাইপারটেনশনে ভুগে থাকে যার আজ পর্যন্ত কোনো শনাক্তযোগ্য কারণ পাওয়া যায় নাই। তবে জেনেটিক্স, বয়স ও অস্বাস্থ্যকর জীবন যাপন এক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করতে পারে। অন্যদিকে সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন অন্য একটি রোগ, যেমন কিডনি বা হরমোনজনিত অসুস্থতার ফল হিসাবে দেখা দিতে পারে।
বিভিন্ন প্রকার স্বাস্থ্য ঝুঁকির সাথে উচ্চ রক্তচাপের সম্পর্ক রয়েছে। যেমন বয়স (বয়সের সাথে ঝুঁকি বাড়ে), উচ্চ রক্তচাপের পারিবারিক ইতিহাস, অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, বেশি লবণ এবং স্যাচুরেটেড ফ্যাটযুক্ত খাবার, অত্যধিক অ্যালকোহল সেবন, ধূমপান, দীর্ঘস্থায়ী স্ট্রেস, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, স্লিপ এপনিয়া এবং কিছু ওষুধ যেমন ননস্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগ এবং গর্ভনিরোধক বড়ি বা ইঞ্জেকশন।
উপরন্তু, জাতি (আফ্রিকান আমেরিকানদের মধ্যে উচ্চ হার), লিঙ্গ (পুরুষদের মধ্যে উচ্চ হার) এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থার মতো কারণগুলিও উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার ঝুঁকিতে অবদান রাখতে পারে। এই ঝুঁকির কারণগুলি সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং উচ্চ রক্তচাপ কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করার জন্য উপযুক্ত জীবনাচরনে অভ্যস্ত হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত রক্তচাপ মাপা এবং এব্যাপারে বিশেষজ্ঞের পরামর্শও রোগ সনাক্তকরণ এবং চিকিৎসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসা ব্যাপক পরিকল্পনামাফিক হতে হয়, যাতে চিকিৎসকের সাথে রোগীকেও সম্পৃক্ত থাকতে হয়। জীবনযাপনের পরিবর্তনে রোগী ও তার পরিবারও জড়িত থাকে। কিছু ক্ষেত্রে ওষুধ দেওয়া অনিবার্য হয়ে থাকে। এখানে উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসার মূল দিকগুলি আলোচনা করা হল:
লাইফস্টাইল পরিবর্তন: একটি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের পদ্ধতি গ্রহণ করা হাইপারটেনশন চিকিৎসার মূল ভিত্তি। এর মধ্যে রয়েছে ফলমূল, শাকসবজি, চর্বিহীন প্রোটিন এবং কম চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত খাদ্য গ্রহণ। সুষম খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা এবং সোডিয়াম, স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং কোলেস্টেরল গ্রহণ কমানো। নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম, যেমন এরোবিকস, কার্ডিও ও শক্তি বৃদ্ধির ব্যায়াম করা অপরিহার্য। স্থূলতা কমিয়া রাখা, ধূমপান ও অ্যালকোহল সেবন বন্ধ বা সীমিত করাও রক্তচাপের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
ওষুধ: যেসব ক্ষেত্রে শুধুমাত্র জীবনযাত্রার পরিবর্তনই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট নয়, সেক্ষেত্রে ওষুধ দেওয়া যেতে পারে। বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিহাইপারটেনসিভ ওষুধ পাওয়া যায়, যেমন মূত্রবর্ধক, বিটা-ব্লকার, এসিই ইনহিবিটরস ( ACEI), অ্যাঞ্জিওটেনসিন রিসেপ্টর ব্লকার (ARB), ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার (CCB) এবং অন্যান্য। রক্তচাপের মাত্রা, সামগ্রিক স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য অসুস্থতার উপর নির্ভর করে চিকিৎসকেরা ওষুধ নির্বাচন করে থাকেন।
নিয়মিত চেক-আপ বা পর্যবেক্ষণ: নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করা চিকিৎসা কার্যকর কিনা তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ। হোম ব্লাড প্রেশার মনিটরিং নিজে বা পরিবারের কেউ শিখে নিলে ভালো, তবে এ ব্যপারে বিশেষজ্ঞ বা পেশাদার স্বাস্থ্যসেবকের নির্দেশিকা অনুসরণ করা গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাস্থ্যকর অভ্যাস: খাদ্যতালিকাগত পরিবর্তন এবং ব্যায়াম ছাড়াও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর অভ্যাস রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে অবদান রাখে। এর মধ্যে রয়েছে ধূমপান ত্যাগ করা, রিল্যাক্সেশন বা শিথিলকরণ বা কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা, পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানো এবং অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণ এড়িয়ে চলা।
উপরোক্ত কৌশলগুলি বাস্তবায়ন করে এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক চললে একজন রুগী কার্যকরভাবে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে, রোগের জটিলতার ঝুঁকি কমাতে পারে এবং সামগ্রিক কার্ডিওভাসকুলার সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে পারে।
হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বার্তাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্যসমূহ:
কার্যকরভাবে উচ্চ রক্তচাপ সনাক্ত এবং নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নিয়মিত রক্তচাপ পর্যবেক্ষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং লবণযুক্ত খাদ্যগ্রহণ কমানো সহ জীবনযাত্রার পরিবর্তনগুলি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ধূমপান ত্যাগ করা, অ্যালকোহল বাদ দেওয়া বা সীমিত করা, মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকা এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানো উচ্চ রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অপরিহার্য।
জীবনযাত্রার পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রয়োজনীয় ওষুধ খেতে হতে পারে, এবং এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাথে সহযোগিতা করা ও নিয়মিত সাক্ষাত, তাঁর দেওয়া নির্দেশিকা এবং প্রয়োজনে চিকিৎসা পরিকল্পনা সামঞ্জস্য করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাস্থ্য ঝুঁকিগুলি অনুধাবন করার মাধ্যমে, প্রয়োজনীয় জীবনধারায় পরিবর্তন এনে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসরণ করে একজন ব্যক্তি কার্যকরভাবে তার উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং উচ্চচাপ জনিত জটিলতার আশংকা কমাতে পারে। এর ফলে সে আরও ভালভাবে তার নিজের জন্য সামগ্রিক কার্ডিওভাসকুলার সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পারে।
লেখক: ডা. এস এম ইয়ার মাহাবুব
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ
সহযোগী অধ্যাপক, কার্ডিওলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ