এ যেন ঢাকার সেই নবাব সলিমুল্লাহ। করেন সরকারি চাকরি। সীমিত আয়। অথচ নামে-বেনামে গড়েছেন অঢেল সম্পদ। খোঁজ মিলেছে এক ডজন ফ্ল্যাট-প্লটের। নিজের নামে নয়, এসব সম্পত্তি কিনেছেন স্ত্রী-কন্যা ও নিকটাত্মীয়দের নামে।
যার সম্পত্তির ফিরিস্তি দেওয়া হচ্ছে তিনি আর কেউ নন, টানা ১৬ বছর একই মন্ত্রণালয়ে থাকা অতিরিক্ত সচিব মো. সলিম উল্লাহ (পরিচিতি নং ৬৩২৯)। অনেকে তাকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের ‘নবাব সলিম উল্লাহ’ বলেও ডাকেন।
শেখ হাসিনা সরকারের পায়রবি করে দেড় দশক কাটিয়ে দিয়েছেন একই মন্ত্রণালয়ে। ওই দফতরের নাড়ি-নক্ষত্র তার নখদর্পণে। এ কারণে অর্থ হাতানোর লাইন-ঘাটগুলোও তারই সৃষ্ট। বিভিন্ন দফতরের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা ওএসডি, বদলি কিংবা চাকরি হারিয়েছেন। আর সলিম উল্লাহর চেয়ার চলে গেলেও বহাল আছে চাকরিটা।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি অনুসন্ধান নথির তথ্যমতে, শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (নীতি, আইন ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা) মোঃ সলিম উল্লাহ নামে-বেনামে গড়েছেন বিপুল পরিমাণ সম্পদ।
রাজউক পূর্বাচল প্রকল্পের ‘এফ’ ব্লকে দুই মেয়ের নামে রয়েছে ৫ কাঠার করে ২টি প্লট। এগুলোর নম্বর যথাক্রমে- ৩৮২ ও ৩৮৩। রাজউকের উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট দ্বিতীয় ফেজে স্ত্রীর নামে রয়েছে একটি প্লট (ব্লক-এইচ, প্লট নং-২০২)।
মোহাম্মদপুরের জাপান গার্ডেন সিটিতে কয়েকটি ফ্ল্যাট রয়েছে তার। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় রয়েছে একাধিক প্লট ও ফ্ল্যাট। মিরপুর এলাকায় রয়েছে অন্তত পাঁচটি বড় ফ্ল্যাট। হাতিরঝিলের প্রবেশ মুখে সুরম্য অট্টালিকায় রয়েছে বিলাস বহুল ফ্ল্যাট। মগবাজারে (৫৫৭/এ/১২,মধুবাগ) রয়েছে ৫ কাঠার ওপর পাঁচতলা ভবন। এটি তার শ্বশুরের নামে কেনা-মর্মে সংস্থাটির নথিতে উল্লেখ রয়েছে। রাজউক হাতিরঝিল আবাসন এলাকায় (ভবন-১, ফ্ল্যাট নং-এ-২) রয়েছে ফ্ল্যাট।
নথিপ্রাপ্ত তথ্যমতে, মো. সলিম উল্লাহ চাকরি জীবনের শুরুর দিকে গাজীপুর কালিয়াকৈর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ছিলেন। সেখান থেকেই দু’হাতে টাকা কামিয়েছেন। শিল্প মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেন সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে।
শেখ হাসিনা সরকারের পদলেহন করলেও দুর্নীতি, অনিয়মসহ নানা কারণে তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। গত জুলাৈই-আগস্টে ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশত্যঅগ করেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে তিনি বনে যান ‘পদোন্নতি বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার’ সরকারি কর্মকর্তা।
ড. ইউনূস সরকারের এ সময়ে আলোচিত ২৬ সচিবের কাতারেই পরপর তিনটি প্রমোশন বাগিয়ে নেন সলিম উল্লাহ। চলতি বছর সেপ্টেম্বরে হন উপ-সচিব। পরবর্তীতে যুগ্ম-সচিব এবং সর্বশেষ অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি নেন।
বর্তমান সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তি আলী ইমাম মজুমদারের কৃপাদৃষ্টি লাভে সক্ষম সলিমউল্লাহ পদায়নও নেন নিজ পছন্দমতো। দীর্ঘদিন একই মন্ত্রণালয়ে থাকায় এটি হয়ে উঠেছে তার আয়-উন্নতির তীর্থস্থান। তদবির ও দেন-দরবার করে এ মন্ত্রণালয়েই তিনি পোস্টিং বাগিয়ে নেন।
অবৈধ আয়ের উৎস
শিল্প মন্ত্রণালয়ে এ ‘নবাব’ সলিম উল্লাহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ফলে মন্ত্রণালয়ের প্রায় সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকেই তিনি চেনেন-জানেন। তিনি তা কাজে লাগিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের ওপর প্রভাব বিস্তার চালিয়ে যাচ্ছেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন যেন তার জন্যে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন দফতরগুলোতে ‘নবাব’ সলিমুল্লাহ বলয় আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন দফতরের ভৌত উন্নয়ন কাজের প্রকল্পগুলোর শত শত কোটি টাকার টেন্ডার বাণিজ্যের ‘অঘোষিত নবাব’ তিনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিসিকের চলমান পাঁচটি প্রকল্পে মাটি ভরাটের কাজ, রাস্তা নির্মাণ, বাউন্ডারি নির্মাণ, ড্রেন-কাল্ভার্ট নির্মাণ ও অন্যান্য পূর্ত কাজের টেন্ডারগুলোতে রয়েছে তার দূর-নিয়ন্ত্রিত অদৃশ্য কালোহাত। অভিনব কৌশলে এবং বিসিকের প্রকল্প পরিচালকদের (পিডি) ওপর চাপ সৃষ্টি করে প্রকল্পের কাজের প্রাক্কলিত মূল্য (অ্যাস্টিমেটেড অ্যামাউন্ট) সংগ্রহ করে সেটি টেন্ডার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কাছে তথ্য ফাঁস করারও অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। এভাবেই পছন্দের ঠিকাদারের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন কমিশনের লাখ লাখ টাকা।
সাবেক অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) নূরুল আমিন খান, মোমিনুল ইসলামসহ চিহ্নিত কয়েকজন ঠিকাদার (বিসিআইসি’র পোটন ট্রেডার্স, নাসির এন্টারপ্রাইজের আবু নাসির, সোহান গ্রুপের জাকির হোসেন) কর্মচারী ইউনিয়নের নেতা মো. আকরাম হোসেনকে নিয়ে সলিম উল্লাহ গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট।
দুর্নীতির কারণে সম্প্রতি যুগ্ম সচিব নূরুল আমিন খানকে (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) থেকে সরিয়ে যুগ্ম সচিব (বিএবিও বয়লার) শাখায় সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তাতে সতর্ক না হয়ে সলিম উল্লাহ বরং সিন্ডিকেটবাজি অব্যাহত রেখেছেন।
একই দফতরে ১৬ বছর
অবৈধ অর্থ উপার্জনে সলিম উল্লাহ’র আরেকটি বড় উৎস হচ্ছে, শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন করপোরেশনগুলোর কেনাকাটা ও সরবরাহ কাজ নিয়ন্ত্রণ। বিসিআইসি’র সার সরবরাহ ও বিভিন্ন সরবরাহ কাজে রয়েছে তার অদৃশ্য হাত। দীর্ঘদিন একই মন্ত্রণালয়ে থাকায় আত্মীয়-স্বজন ও ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন সাপ্লাইয়ের নিজস্ব সিন্ডিকেট।
সলিম উল্লাহ সিন্ডিকেটের বাইরে কেউ কোনো পণ্য বিসিআইসিতে সরবরাহ করতে পারেন না। এ সবই হচ্ছে একই মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘদিন অবস্থান করার কারণে। অথচ সরকারি চাকরির সাধারণ নীতিমালা অনুযায়ী মো. সলিম উল্লাহ একই মন্ত্রণালয়ে ৩ বছরের বেশি থাকার কথা নয়।
১৯৮৩ সালের ২২ মে মন্ত্রিপরিষদ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ‘সরকারি ও বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা/দফততর/পরিদফতর এবং অন্যান্য বদলিযোগ্য কর্মকর্তা যারা একই স্থানে/একই পদে তিন বৎসরের বেশি দিন কর্মরত রয়েছেন, তাহাদের অবিলম্বে বদলি করতে হইবে।’
সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের (বর্তমান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়) ১৯৮৩ সালের ১৩ জুন এক চিঠিতে {ইডি/এস এ ১-১৩/৮৩-২৫৭(১০০)} উল্লেখ রয়েছে, ‘উল্লিখিত মন্ত্রিপরিষদ সিদ্ধান্তের কোনো ব্যতিক্রম ঘটলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে সরকারি আইন ও সরকারি বিধি অনুসারে চাকুরিচ্যুতসহ যে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু প্রভাবশালী অতিরিক্ত সচিব মো. সলিম উল্লাহ আইন লঙ্ঘন করেও দীর্ঘ মেয়াদে চাকরি করে গেছেন। এখন তিনি ওএসডি।
দুদকের মুখপাত্র (মহাপরিচালক) মো. আকতার হোসেন বলেন, দুদকে বর্তমানে কমিশন নেই। সদ্য বিদায়ী কমিশন যদি অভিযোগ অনুসন্ধানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়ে যায় তবে তার অনুসন্ধানে চলমান আছে। তবে মো. সলিমুল্লাহ’র বিষয়ে কোনো আপডেট তথ্য আমার কাছে নেই।
এদিকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সংযুক্তি) মোঃ সলিম উল্লাহ’র বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সম্পর্কে জানতে ০১৫৫৭****৫৭ একাধিকবার কল ও বার্তা পাঠিয়েও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সংবাদচিত্র ডটকম/দুদক