অভিনেত্রী রাইমা ইসলাম শিমু মোবাইল ফোনে কার সংগে কথা বলেন বা কোথায় যান এসব নিয়ে প্রতিনিয়ত সন্দেহ করতেন স্বামী সাখাওয়াত আলীম নোবেল।
ঘটনার দিন সকালে হঠাৎ স্ত্রীর ফোন দেখতে চান নোবেল। এই নিয়েই ঝগড়া-হাতাহাতি থেকে শেষ পর্যন্ত গলা চেপে ধরলে মারা যান শিমু। নোবেল একা নয়, হত্যাকাণ্ডের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন বাল্য বন্ধু এস এম ওয়াই আব্দুল্লাহ ফরহাদও। শিমু’র স্বামী নোবেলকে হত্যাকাণ্ডে সহায়তাও করেন ফরহাদ।
ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় তিন দিনের রিমান্ডের প্রথমদিন শেষেই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এমন কথাই জানিয়েছেন সাখাওয়াত আলীম নোবেল ও ফরহাদ।
বৃহস্পতিবার (২০ জানুয়ারি) ঢাকার দুই জন বিচারিক হাকিমের আলাদা খাস কামরায় ১৬৪ ধারায় তারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। নোবেল-এর স্বীকারোক্তি নেন বিচারিক হাকিম মো. সাইফুল ইসলাম ও তার বন্ধু ফরহাদ-এর জবানবন্দি নেন জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মিশকাত সুকরানা। দাম্পত্য কলহের সূত্র ধরেই এই খুনের কথা তাদের স্বীকারোক্তিতে এসেছে।
ঘটনার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্ত্রী মোবাইল ফোনে কার সংগে কথা বলেন বা কোথায় যান, এসব নিয়ে প্রতিনিয়ত সন্দেহ করতেন নোবেল। রবিবার (১৬ জানুয়ারি) সকালে শিমু’র মোবাইলে কল আসে। তখন কে কল করলো তা দেখতে চান নোবেল, এতে বাধা দেন শিমু। এই নিয়ে দুই জনের মধ্যে ঝগড়া হয়, যা হাতাহাতিতে রূপ নেয়। একপর্যায়ে শিমুর গলা চেপে ধরলে তিনি মারা যান।
গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ ও রিমান্ডের প্রথম দিন নোবেল দাবি করেন, তিনি একাই শ্বাসরোধ করে স্ত্রীকে হত্যা করেন। পরে মৃতদেহ গুম করতে বাল্যবন্ধু ফরহাদকে ডেকে নেন। ফরহাদ পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে দাবি করেছেন, হত্যার আগে তিনি কিছুই জানতেন না। বন্ধুর ফোনে সাড়া দিয়ে হত্যাকাণ্ডের পর ওই বাসায় গিয়েছিলেন তিনি।
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উঠে এসেছে, নোবেল একা নয়, হত্যাকাণ্ডের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন ফরহাদ। দুই বন্ধু মিলেই শিমুকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন।
সূত্র জানায়, ওই দিন সকালে নোবেলের বাসায় যান ফরহাদ। ফরহাদ যাওয়ার পর বাসার দরজাও খুলে দেন শিমু। এরপর তারা ডাইনিং টেবিলে বসে চা খান। কিছুক্ষণ পর শিমু’র ফোন দেখা নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া শুরু হলে ফরহাদ প্রথমে থামানোর চেষ্টা করেন।
একপর্যায়ে নোবেল উত্তেজিত হয়ে স্ত্রীকে শেষ করে দেওয়ার কথা বলেন। এতে সহায়তা চাইলে ফরহাদও সাড়া দেন। তাৎক্ষণিকভাবে দু’জন মিলে শিমুকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়।
পুলিশের বর্ণনা অনুযায়ী, শিমুকে হত্যা করে নিখোঁজের নাটক সাজাতে চেয়েছিলো তাঁর স্বামী নোবেল। পরিকল্পনা ছিলো মৃতদেহ গুম করা বা অজ্ঞাত হিসেবে ফেলে দেওয়া। এই জন্য নোবেল তাঁর বন্ধু এস এম ওয়াই আব্দুল্লাহ ফরহাদ-এর সহায়তায় মৃতদেহ দুই খণ্ড করে বস্তায় ভরে কেরানীগঞ্জে নিয়ে ফেলেন। কেরানীগঞ্জ থেকে শিমু’র দ্বিখণ্ডিত মৃতদেহ উদ্ধারের পর পরই ঘটনার রহস্য উদঘাটনে নামে পুলিশ। পুলিশের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপে নিখোঁজের নাটক পন্ড হয় তাদের।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শিমু’র মৃতদেহ যে বস্তায় রাখা হয়েছিলো, সেই বস্তা সেলাই করা সুতার মাধ্যমে সন্দেহের আওতায় আসেন তাঁর স্বামী নোবেল। একই রকমের সুতা নোবেল-এর, বাসায় পাওয়া যায়। এছাড়া গাড়িটি ধুয়ে ব্লিচিং পাউডার ছিটানোর আলামতও মেলে। এরপর মেলে যোগসূত্র।
জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে নোবেল স্বীকার করেন, তিনি শিমুকে গলা টিপে হত্যা করেন। এরপর বন্ধু ফরহাদকে মোবাইল ফোনে কল করে ডেকে নেন। পরে ফরহাদ ও নোবেল পরিকল্পনা করে বাইরে থেকে বস্তা এনে শিমু’র মৃতদেহ লম্বালম্বিভাবে দু’টি পাটের বস্তায় ভরে প্লাস্টিকের সুতা দিয়ে সেলাই করেন। এরপর চালাকি করে বাড়ির দারোয়ানকে নাশতা আনতে বাইরে পাঠিয়ে দেয়। এছাড়া এই দৃশ্য যেন সিসি ক্যামেরায় ধরা না পড়ে তাই বন্ধ করে দেওয়া হয় মেইন সুইচ। এরপর নিজের ব্যক্তিগত গাড়ির পেছনের আসনে শিমু’র মৃতদেহ নিয়ে বেরিয়ে যান।
জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানান, ভীড়ের কারণে মৃতদেহ ফেলতে না পারায় মিরপুরের রূপনগর ও বেরিবাঁধে ঘোরাঘুরি করে রবিবার সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আসেন। পরে রাত দশটার দিকে আবার বের হয়ে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, বসিলা ব্রিজ হয়ে কেরানীগঞ্জ মডেল থানার হযরতপুর ইউনিয়নের ওই এলাকায় সড়কের পাশে ঝোপের ভেতর মৃতদেহ ফেলে আসেন তারা। পরে রাত ১২ টার দিকে কলাবাগান থানায় জিডি করতে যান নোবেল। জিডিতে বলেন, রবিবার সকালে কাউকে কিছু না বলে কলাবাগানের বাসা থেকে বের হয়ে গেছেন শিমু। কিন্তু মৃতদেহ উদ্ধারের পর শিমু’র বাসা থেকে এক গোছা সুতা উদ্ধার করে পুলিশ। যে সুতা দিয়ে মৃতদেহের বস্তা সেলােই করা হয়েছে।
জানা গেছে শিমু’র গ্রামের বাড়ি পিরোজপুর জেলার সদর থানার সিআইপাড়া এলাকায়। তাঁর বাবার নাম নূর ইসলাম। শিমু ১৮ বছর আগে ফরিদপুরের কমলপুর গ্রামের নোবেলকে প্রেম করে বিয়ে করেন। তাঁদের ১৬ বছরের একটি মেয়ে ও সাত বছরের একটি ছেলে আছে।
সংবাদচিত্র/আইন ও বিচার