নৌকাডুবির শিকার মা ও মেয়ের প্রাণ বাঁচিয়ে নিজেই হাওরের অতল জলে তলিয়ে গেলেন সাবিকুল ইসলাম (২৪)। এই তরুণের বাড়ি কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের বরাগীরকান্দি গ্রামে। এক সন্তানের জনক সাবিকুল হেমন্তকালে ইজিবাইক ও বর্ষায় নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
গত সোমবার (১০ জুলাই) বিকালে হাওরের অল ওয়েদার রোডের অষ্টগ্রামের ভাতশালা গ্রামের কাছে বাইশ মিটার দীর্ঘ সেতুর নিচে এ মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে। তাঁর এমন মৃত্যুতে হাওরে বিষাদের ছায়া নেমে আসে।
অন্যের জীবন বাঁচাতে গিয়ে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে সাবিকুল ভাসছেন প্রশংসায়। তাঁকে ‘মহানুভব’, ‘মানবতাবাদী’-এমন বিশেষণে বিশেষায়িত করছেন হাওরবাসী। অনেকেই ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাবি তুলছেন, হাওরের অল ওয়েদার রোডের যে সেতুতে সাবিকুল প্রাণোৎসর্গ করেছেন; সেই ‘বাইশ মিটার সেতু’ যেন সাবিকুলের নামে নামকরণ করা হয়।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, সোমবার বিকালে অষ্টগ্রামের কলমা ইউনিয়নের কাকরিয়া গ্রামের আত্মীয় বাড়ি থেকে নিজ বাড়ি বাজিতপুরের বোয়ালী গ্রামে ডিঙ্গি নৌকায় ছেলেমেয়েসহ ফিরছিলেন গিরিধর সরকার, তাঁর স্ত্রী ববিতা রানী সরকারসহ সাত যাত্রী। সঙ্গে ছিল একটি গাভীও। নৌকাটি অল ওয়েদার রোডের বাইশ মিটার সেতু পার হওয়ার সময় প্রবল স্রোতে ডুবে যায়। ঘটনার সময় মিঠামইন থেকে একই রাস্তায় মোটরসাইকেলে ফিরে আসছিলেন সাবিকুল।
পুলিশ, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও এলাকাবাসী জানায়, চোখের সামনে এমন ঘটনায় স্তম্ভিত সাবিকুল মোটরসাইকেল রাস্তায় ফেলে নৌযাত্রীদের উদ্ধারে সেতুর নিচে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এরপর প্রাণপণে একে একে গৃহবধূ ববিতা ও তাঁর সাত বছরের মেয়ে নিপুকে পানির নিচ থেকে জীবিত উদ্ধার করে পারে তুলে আনেন। তৃতীয়জনকে উদ্ধার করতে গিয়ে এক পর্যায়ে নিজেই নিস্তেজ হয়ে পড়েন সাবিকুল। পরে আর ক্লান্ত শরীর নিয়ে সাকিবুল পারে উঠতে না পেরে প্রবল স্রোতের ঘূর্ণিপাকে তলিয়ে যান। খবর পেয়ে অষ্টগ্রাম থানার পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে যায়।
বাজিতপুরের দমকল বাহিনীর ডুবুরিদলের সহায়তায় উদ্ধারকর্মীরা প্রায় ছয় ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে সাবিকুলের লাশ উদ্ধার করে আনে। এদিকে মঙ্গলবার (১১ জুলাই) সকালে নামাজে জানাজা শেষে তাঁর নিজ গ্রাম বরাগীরবান্দি কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়েছে।
সাবিকুলের মহানুভবতা আলোচিত হচ্ছে সর্বত্র। প্রশংসায় ভাসছেন সাবিকুল। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মানবিক তাঁকে নিয়ে চলছে আলোচনা। সবাই হায়-আফসোস করছে তাঁর অকাল মৃত্যুতে। অনেকেই দাবি করেছেন, অন্যের জীবন বাঁচাতে যে সেতুতে নেমে যিনি অকালে প্রাণ হারালেন; তাঁর নামেই সেই সেতুর নামকরণ করা হোক।
ঢাকায় ইন্সপেক্টর পদে কর্মরত অষ্টগ্রামের বাঙ্গালপাড়ার তুষার দাস তাঁর ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘অন্যের জীবন বাঁচাতে গিয়ে সাবিকুল নিজের জীবন দান করে মানবজাতির শ্রেষ্ঠত্বকে প্রমাণ করে গেলেন। আজ থেকে এ সেতুকে ‘সাবিকুল সেতু’ নামে ডাকব। প্রশাসনের কাছে অনুরোধ জানাই, এ নামের যেন সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়’।
সহকারী পুলিশ সুপার পদে রংপুরের র্যাবে কর্মরত অষ্টগ্রামের বাঙ্গালপাড়ার মোস্তাফিজুর রহমান লিঙ্কন তামিল সিনেমার গল্পের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘সাবিকুলের ঘটনা নিয়ে হয়তো সিনেমা তৈরি হবে না। তবে মানবেতিহাসে আমাদের মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকার সাহস যোগাবে’। সেতুটি সাবিকুলের নামে নামকরণের দাবি জানিয়ে তিনি লিখেন, ‘প্রজন্ম জানুক জীবনের তরে এক যুবকের প্রণোৎসর্গের কথা’।
কথা হয় সাবিকুলের চাচা মফিজ উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি জানান, সাবিকুল খুবই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। শুকনো মৌসুমে তিনি আদমপুর-কাটাগাঙ রোডে ইজিবাইজ ও বর্ষাকালে নৌকা চালাতেন। ভালো উপার্জনের আশায় এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে এবার একটি ‘গস্তি নৌকা’ তৈরি করেন। বর্ষায় আদমপুর-বুল্লা নৌপথে যাত্রী বহন করতে শুরু করেছিলেন। দুই বন্ধুকে নিয়ে ঘটনার দিন অষ্টগ্রাম সদরে বোনের বাড়ি যান সাবিকুল। পরে অল ওয়েদার সড়কে বেড়াতে গিয়ে ফেরার পথে নৌকাডুবিতে অন্যদের উদ্ধারে নেমে নিজেই লাশ হয়ে ফেরেন।
সাবিকুলের গ্রামের বাসিন্দা ব্যবসায়ী জাকির হোসেন গণমাধ্যমকে জানান, খুবই সৎ ও সাহসী স্বভাবের ছেলে ছিলেন সাবিকুল। এর আগেও আদমপুর বাজারে আগুন লাগলে সাবিকুল আগুন নেভাতে গিয়ে দুঃসাহস দেখিয়ে প্রশংসিত হয়েছেন। তবে তাঁর নিজের বাড়ি নেই। অন্যের বাড়ি বন্ধক রেখে তাতে ঘর তুলে সাবিকুল বসবাস করেন।
সাবিকুলের সায়মন নামে তিন বছর বয়েসী একটি ছেলে রয়েছে। স্ত্রী পরশমণি আক্তার (২০) আবারো সন্তান সম্ভবা। সাবিকুলের মা নূরজাহান বেগম ছেলেকে অকালে হারিয়ে পাগলপ্রায়। তিনি কেবলই কাঁদছেন। মাঝে মাঝে জ্ঞান হারাচ্ছেন। বলছেন, ‘এইডা কী হইল। আমার সাবিকুল কই গেল’!
আদমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মোন্নাফ এ ঘটনায় শোকগ্রস্ত। তিনি জানান, সাবিকুলের জানাজা শেষে তাকে বৈরাগীকান্দি তাঁদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
অষ্টগ্রাম থানার ওসি মোহাম্মদ মোর্শেদ জামান জানান, থানার পুলিশের সহায়তায় বাজিতপুর ফায়ার সার্ভিসের একটি ডুবুরি দল কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় সাবিকুলের মরদেহ উদ্ধার করে।
সংবাদচিত্র ডটকম/বিশেষ সংবাদ