বিএনপি ভোটের জন্য যেকোনো সময়ই প্রস্তুত বলে মন্তব্য করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গত মঙ্গলবার সকালে গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, “আমরা তো বলেছি, আপনি যদি ইলেকশন কালকে করতে পারেন, আমরা কালকেই রেডি। কারণ এটা (বিএনপি) নির্বাচনের দল, নির্বাচন করেই বিএনপি ক্ষমতায় যেতে চায়।”
মির্জা ফখরুল বলেন, “ভাই, আমি তো বিপ্লবী দল নই। আমাদের পরিষ্কার কথা, আমরা কোনো বিপ্লবী দল নই, আমরা নির্বাচন করেই জনগণের ভোটের মাধ্যমে আমরা ক্ষমতায় যেতে চাই। যখন সবাই চাইবে, একমত হবে, তখন নির্বাচন হবে, অসুবিধা নাই।”
উল্লেখ্য চোখের অস্ত্রোচারের জন্য থাইল্যান্ডে গিয়েছিলেন বিএনপি মহাসচিব। সেখানে অস্ত্রোপচারের পর দেশে ফেরেন ঈদের আগের রাতে।
সাংবাদিকদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে মঙ্গলবার গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আসেন বিএনপি মহাসচিব। রাজনীতি, নির্বাচন, লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠক, নির্বাচনের শরিকদের সাথে আসন সমঝোতা, অন্তবর্তী সরকারের কর্মকাণ্ড, সংস্কার কমিশনসহ নানা বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের খোলামেলা জবাব দেন মির্জা ফখরুল।
ডিসেম্বরে নির্বাচন খুবই সম্ভব
মির্জা ফখরুল বলেন, “আমাদের দল বলেছে যে, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব এবং এটা খুবই সম্ভব। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাহেব বলেছেন এ কথা। আমি বিশ্বাস করি, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হওয়া সম্ভব।”
জামায়াতে ইসলামী বলেছে এপ্রিলে নির্বাচন হতে পারে। দলটির এমন মনোভাবে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে কিনা, তা জানতে চান এক সাংবাদিক।
জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, “একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, ডেমোক্রেসির মূল কথা হচ্ছে, আপনি আমার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করবেন, আমি আপনার সঙ্গে ভিন্নমত পোষন করব। কিন্তু তাই বলে আমি মনে করব না যে, আপনি আমার শত্রু, তাই বলে আমি মনে করব না যে, আপনি দেশদ্রোহী হয়ে গেছেন, আপনি গণতন্ত্রবিরোধী হয়ে গেছেন। আমি মনে করব, এটাই গণতন্ত্রের বিউটি।”
এপ্রিলে নির্বাচন: বিএনপির অবস্থান কি হবে
মির্জা ফখরুল বলেন, “দেখুন এই ব্যাপারে আমরা দলগত কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি। আমরা আশা করছি যে, সরকারকে একটা বিবেচনা করতে, কিছুটা বলা যেতে পারে বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতেই তারা বিবেচনা করবেন।
“সময়টা(এপ্রিল) তো ঠিক না। আমি প্রথম দিন বলেছি, টাইম ইজ নট গুড ফর ইলেকশন। এপ্রিল মাস, আপনার রোজার মাস, রোজ শেষ হবে, ঈদ শেষ হবে। এর কয়েক দিন পরে নির্বাচন। আপনি ভাবেন রোজার মাসটায় প্রার্থীদের কী অবস্থা হবে…রাজনৈতিক কর্মীদের কী অবস্থা হবে? আমি নিজেই এখন চিন্তিত যে, প্রত্যেক দিন আমাকে ইফতার পার্টি করতে হবে। ইটস নো জোক। এটা বিরাট ব্যাপার। প্রার্থীদের ব্যয় দ্বিগুন হয়ে যাবে এবং এই ক্ষেত্রে আমরা চিৎকার করি অর্থ ব্যয় কমাতে হবে, ওই সময় হলে তো ব্যয় বাড়বে।”
তিনি বলেন, “শুধু তাই নয়, ওই সময় প্রচন্ড গরম থাকবে আবহাওয়া, ঝড়-বৃষ্টি আছে। দিনের বেলা আমাদের যে নির্বাচনী কালচার, জনসভা করতে হয়, সেই জনসভায় লোকজন আনাটাই মুশকিল হবে। রোদ্রে মধ্যে কে আসবে? রাত্রিবেলা মিটিং করতে হবে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ সময়ে ডিসেম্বর-নভেম্বর-জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হয়েছে। দুবার বোধহয় হয়েছে ভিন্ন সময়ে, দুই ইলেকশনই ঝামেলা ছিল।”
লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন যুক্তরাজ্য সফররত প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। শুক্রবার স্থানীয় সময় সকাল ৯টা থেকে ১১টার মধ্যে এ বৈঠক হওয়ার কথা বলছে বিএনপি।
এক সাংবাদিক জানতে চান, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে ভোটের তারিখে কোনো পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা দেখেন কিনা।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আমি খুবই ইতিবাচক মানুষ এবং আমি সবসময়ে পজেটিভ দিকটাই দেখতে চাই, ব্রাইট দিকটা দেখতে চাই। তাতে করে আমি মনে করি, এই একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
“এটাই সঠিক সময়, সঠিক স্থান, সঠিক জায়গা, যেখানে নতুন দিগন্তের উন্মোচন হতে পারে আর কি।”
সরকারের আন্তরিকতা অভাব নেই
তিনি বলেন, “একটা বিশেষ মুহুর্তে এসে তারা অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছেন, তাদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। একথা বললে অস্বীকার করা হবে না যে, আমরাই দায়িত্ব দিয়েছি। কিন্তু রাজনৈতিক দিক থেকে তাদের অভিজ্ঞতা যথেষ্ট নয়। তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে সবাই অত্যন্ত অভিজ্ঞ মানুষ, পণ্ডিত লোক, উইজডোম সব আছে, কিন্তু পলিটিক্যাল উইজডোম যে পুরোপুরি আছে সেটা বলা যাবে না।”
“কিন্তু আন্তরিকতার অভাব আছে বলে আমার কাছে মনে হয় না। তারা কাজ করতে চান, কাজ করছেন। দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন হতে পারে। তবে এখানে একটা ইউনিক যে, এখানে একটা চাপ আছে। চাপটা হচ্ছে, আপনারা জানেন যে, এখানে নতুন নতুন রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার সৃষ্টি হচ্ছে, নতুন নতুন রাজনৈতিক চিন্তা আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবেলা করে একটা জায়গায় নিয়ে আসা, এটাও বড় একটা চ্যালেঞ্জিং জব কিন্তু। সেই ক্ষেত্রে আমি মনে করি, একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে দুই নেতার মিটিংয়ের মধ্য দিয়ে একটা বড় সমাধান হয়ে যেতে পারে। একেবারে মুহুর্তের মধ্যে বাংলাদেশের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।”
তিনি বলেন, “ভালো কথা হচ্ছে যে, সবাই আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছেন, রাজনৈতিক দলগুলোও চেষ্টা করছে। আমি কাউকেই অভিযুক্ত করতে চাই না, কারো বিরুদ্ধে বলতে চাই না। আমি মনে করি সবাই সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।”
টিক মার্ক দিয়ে কি রাজনীতি হয়?
মির্জা ফখরুল বলেন, “সংস্কার কমিশনগুলো যেভাবে জানতে চেয়েছে, এটা অনেকটা স্কুলের টিক মার্ক দিয়ে, টিক মার্ক দিয়ে কি রাজনীতি হয় নাকি। এটা একটা অসম্ভব ব্যাপার। আমরা বলেছি, প্রধানমন্ত্রী পরপর দুই বারের বেশি কেউ হতে পারবেন না। আবার বলেছি যে, এক বছর বাদ দিয়ে আরেক বার হতে পারবেন। অর্থাৎ তিনবার। আমরা তো একথা বলিনি যে, তারপরেও হতে পারবেন।”
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। মঙ্গলবার ঢাকার গুলশানে; বিএনপি চেয়ারপারসের কার্যালয়ে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। মঙ্গলবার ঢাকার গুলশানে; বিএনপি চেয়ারপারসের কার্যালয়ে।
‘বিএনপি ইজ রিয়েলিটি’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, “কেমন জানি একটা নেতিবাচক প্রচারণা বিএনপির বিরুদ্ধে চলছে। কিন্তু কারণটা কি? আমরা তো নতুন নতুন সংস্কারের কাজ করেছি তো, পরিবর্তন আনার কাজ করেছি তো। এখন আমি জানি না কিছু মানুষ আছেন বিএনপির বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য বলেই যাচ্ছেন।
“বাস্তবতা হচ্ছে যে, বিএনপি ইজ এ রিয়েলিটি। বিএনপি এমন একটা দল, একে যতকিছুই বলুক, তাকে সহজেই শেষ করা যায় না, কখনই যায়নি।”
কেয়ার টেকার সরকার কেনো দরকার
মির্জা ফখরুল বলেন, “কেয়ারটেকার ব্যবস্থা বাতিলের দিনই ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) বলেছিলেন যে, একটা বীজ বপন করা হল চিরস্থায়ীভাবে রাজনীতিতে অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তা তৈরির জন্য। আমরাও একইভাবে সেই কথা বলে গেছি। কেয়ারটেকার কেন দরকার? বার বার করে আমাদের পশ্চিমারা কিছুটা বলা যায় যে, আমাদেরকে কি আপনারা হিউমোলেটেড করার চেষ্টা করছেন। কারণ ওদের দেশে এগুলো নাই।
“আমি বলেছি, তুমি তো এটা বুঝবা না। আমাদের চোখ দিয়ে দেখতে হবে। কারণ এখানে উই ডোন্ট ট্রাস্ট ইজ আদার। আমরা একটা দল আরেকটা দলকে বিশ্বাস করি না। যে যখন আমরা ক্ষমতায় যাই, দখল করার চেষ্টা করি। সেজন্যেই ওইসময়ে একটা নিরপেক্ষ সরকার থাকাটাই একটা সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের একমাত্র জায়গা। ওরাই এখন বলছে যে, এটার দরকার হবে। এখন সব দল বলছে, লাগবে এটা।”
নির্বাচনের সময় চলে আসায় অন্তবর্তী সরকারকে কেয়ারটেকার সরকারের ব্যবস্থায় চলে যাওয়া উচিত কিনা জানতে চাইলে ফখরুল বলেন, “আমি আগেই বলেছিলাম কথাটা, ইলেকশন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকা উচিত।”
তিনি বলেন, “কিছুক্ষণ আগে আমার বাসায় কয়েকজন বিনিয়োগকারী, বড় ব্যবসায়ী এসেছিলেন দুঃখের কথা বলতে। দুঃখের কথা কী? তারা কোনো দিকনির্দেশনা পাচ্ছেন না; কী করবেন বুঝতে পারছেন না। ব্যাংকগুলো তাদের সঙ্গে সেভাবে সহযোগিতাও করছে না।
“এ জিনিসগুলো খুবই এলার্মিং। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যদি স্থবির হয়ে পড়ে, তাহলে কিন্তু আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব।”
শরিকদের সমঝোতায় আসন ছাড়বে বিএনপি
আগামী নির্বাচনে শরিকদের আসন ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে মির্জা ফখরুল বলেন, “এটা তো সংসদীয় রাজনীতিতে খুবই স্বাভাবিক, এটা হওয়া উচিত। আমরা আগে থেকে কমিটেড যে, আমরা নির্বাচনের পর একটা জাতীয় সরকার করব।”
এক সাংবাদিক বলেন, জামায়াতে ইসলামী ও ন্যাশনাল রিপাবলিক পার্টিকে বিএনপি আসন ছেড়ে দেবে, এমন আলোচনা আছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
তখন বিএনপি মহাসচিব বলেন, “এগুলোর ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নাই। আলোচনা থাকতে পারে। এই ধরনের কোনো আলোচনা হয়েছে বলে সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে আমার জানা নাই।”
আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার সম্ভাবনা আছে কিনা জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আওয়ামী লীগ তো নাই, ওরা তো নাই।”
জাতীয় পার্টির বিষয়ে অবস্থান জানতে চাইলে বলেন, “আপনারা যেসব পার্টির কথা বলছেন, সেগুলোর সঙ্গে সবচেয়ে বড় বিরোধ বিএনপির। আওয়ামী লীগের সবচেয়ে অত্যাচার-নির্যাতন-নিপীড়ন, ফ্যাসিবাদের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী বিএনপি।”
সংবাদচিত্র ডটকম/রাজনীতি
