পাসপোর্ট অধিদফতরের বিতর্কিত সেই তিন পরিচালকের বিদায়ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছে। ঘুষ, দুর্নীতিসহ অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জনের মধ্য দিয়ে তারা গড়ে তুলেছিলেন অপ্রতিরোধ্য এক সিন্ডিকেট। তারা এতটাই প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন যে অফিসের নিয়ম-শৃঙ্খলার কোনও তোয়াক্কাই করতেন না। সিন্ডিকেট করে তারা গড়েছেন টাকার পাহাড়।
বিতর্কিত এই তিন কর্মকর্তা হলেন— পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন, তৌফিকুল ইসলাম খান ও সাইদুল ইসলাম। ইতোমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি হওয়ার কারণে আব্দুল্লাহ আল মামুন ও তৌফিকুল ইসলাম খানকে বরখাস্ত করেছে মন্ত্রণালয়। আর সাইদুল খানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে, সঙ্গে আসামি করা হয়েছে তার স্ত্রী শায়লা আক্তারকেও।
পাসপোর্ট অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল নুরুল আনোয়ার বলেন, অনিয়ম-দুর্নীতি করে পার পাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। দুই কর্মকর্তাকে মন্ত্রণালয় বরখাস্ত করেছে। একজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হলো। তিনি বলেন, সাইদুল ইসলামের বিরুদ্ধে দুদক মামলা করেছে।
অভিযোগে বলা হয়, অধিদফতরে সাইদুল ইসলাম ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। প্রকাশ্যে ঘুষ নিতেন তিনি। ময়মনসিংহ অফিসে কর্মরত থাকাকালে কোনও নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ব্ল্যাংক পাসপোর্ট ও ভুয়া এনওসির মাধ্যমে অর্ডিনারি ফি’তে জরুরি পাসপোর্ট ইস্যু করে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। যা দিয়ে অল্পদিনের মধ্যে নিজ এলাকা সাঁথিয়ায় ১০ বিঘার ওপর পুকুর ক্রয়, কাশিয়ানি বাজারে ভবনসহ ১০ শতাংশ জায়গা ক্রয়, ২০ বিঘার ওপর ফার্ম, নরসিংদীতে ২৯ ও ৬৫ শতাংশ জায়গার ওপর কারখানা, উত্তরায় প্লট ও ফ্ল্যাট, বছিলা বেড়িবাঁধের পাশে চন্দ্রিমা হাউজিংয়ে ৫ কাঠার প্লট, শ্যাওড়াপাড়ায় ১৭ কাঠা জায়গা, মোহাম্মাদপুরের ইকবাল রোডে ২ হাজার ২০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, ধানমন্ডিতে দুটি ফ্ল্যাটের মালিক হন। যা তিনি নামে-বেনামে করেছেন।
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, কারখানা স্থাপনের জন্য সাইদুল ইসলাম মেঘনা নদীর তীরে সাত বিঘা জমি কিনেছেন। তিনি প্রায় ৩০ কোটি টাকা অবৈধভাবে উপার্জন করেছেন।
দুদকের দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে মঙ্গলবার (২০ মে) মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় তার স্ত্রীকে আসামি করা হয়েছে। বর্তমানে সাইদুল ইসলাম চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক পদে কর্মরত রয়েছেন।
অধিদফতরের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, যেহেতু তার বিরুদ্ধে দুদকের মামলা দায়ের হয়েছে সেহেতু তাকে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগীয় শহরের পরিচালক পদে আর রাখা হবেনা। দু-একদিনের মধ্যে তাকে বদলি করা হবে।
সূত্র জানায়, দুদকের মামলা পর্যালোচনা করে চার্জশিট হওয়ার আগেই তাকে মন্ত্রণালয় বরখাস্ত করতে পারে।
দুদকের দায়ের করা মামলা ও অভিযোগ সম্পর্কে জানতে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে সাইদুল ইসলামের ফোন ধরেননি।
এদিকে পাসপোর্ট অধিদফতরের ‘টাকার কুমির’ খ্যাত পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। গত ২৭ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগ বহির্গমন বিভাগ-৪ শাখা থেকে তার সাময়িক বরখাস্তের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত কার্যালয় ঢাকা-১ এর ২০২২ সালের ২১ জুনে দায়ের করা মামলায় চলতি বছরের গত ১৭ ফেব্রুয়ারি চার্জশিট আদালতে গৃহীত হয়েছে। এ কারণে সরকারি চাকরি আইন-২০১৮ এর ৩৯ (২)- এর বিধি মোতাবেক তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো।
জানা যায়, পাসপোর্টের ঢাকা বিভাগীয় অফিসের পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন অপ্রতিরোধ্য ছিলেন। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের আস্থাভাজন ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে নিয়ম-নীতি, সিনিয়র-জুনিয়র— এমনকি কার সঙ্গে কী ব্যবহার করতে হবে, কিছুই তোয়াক্কা করতেন না তিনি। সরকারি এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এতটাই প্রতাপশালী যে মহাপরিচালকের সামনে তার কোনও আদেশ না মানার ঘোষণা দেন, অতিরিক্ত মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দেন। তার ভয়ে শুধু তার অফিস নয়, প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তারা পর্যন্ত অতিষ্ঠ থাকতেন। বিপুল পরিমাণ বিত্তবৈভবের মালিক তিনি। দুদকের মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি ছাড়াও বেনজীর আহমেদকে অবৈধভাবে পাসপোর্ট দেওয়ার ঘটনার মামলার আসামিও তিনি। সবশেষ তিনি সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
এদিকে পাসপোর্টের ‘টাকার কুমির’ নামে পরিচিত ডাটা অ্যান্ড পার্সোনালাইজেশন সেন্টারের পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম খানকে গত ৯ মার্চ সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
বরখাস্তের আদেশে বলা হয়েছে, যেহেতু তৌফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে দুদকের দায়ের করা মামলার চার্জশিট আদালতে গৃহীত হয়েছে সেহেতু চাকরি আইন, ২০১৮-(২০১৮ সালের ৫৭ নং আইন) এর ধারা ৩৯ (২)-এর বিধান মোতাবেক ২৫-০২-২০২৫ তারিখ থেকে সরকারি চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো।
জানা যায়, ২০০৪ সালে ইমিগ্রেশন এবং পাসপোর্ট অধিদফতরের একজন সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। তার প্রথম পোস্টিং যশোর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে। চাকরি জীবনে তিনি নোয়াখালী, গোপালগঞ্জ, সিলেট, কুমিল্লা, ঢাকার যাত্রাবাড়ী, ঢাকাস্থ হেড অফিস, খুলনা এবং বর্তমানে প্রধান কার্যালয়ের পার্সোনালাইজেশন সেন্টারে পরিচালক হিসেবে ছিলেন।
এর মধ্যে তিনি সহকারী পরিচালক ছিলেন ৭ বছর, উপ-পরিচালক ছিলেন ৮ বছর এবং উভয়পদে মোট ১৫ বছর পূর্ণ হওয়ার ৩ মাসের মধ্যে পরিচালক পদে পদোন্নতি পান। এ সময় তিনি সর্বসাকুল্যে যথাক্রমে- ৫৫ হাজার টাকা, ৬৫ হাজার এবং এখন ৭৫ হাজার টাকা করে বেতন তুলছেন। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে তিনি ঢাকায় ফ্ল্যাট ৮টি, প্লট ৭টি ও বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হয়ে যান।
দুদকের অনুসন্ধান অনুযায়ী, পাসপোর্টের এই পরিচালকের নামে রয়েছে ঢাকার উত্তরায় ১৫০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট যা কেনা হয় ১ কোটি ১০ লাখ টাকায়। ধানমণ্ডিতে ২ হাজার বর্গফুটের প্লট যা কেনা হয় ২ কোটি টাকায়। ধানমন্ডির গ্রিন রোডে ১২৫০ বর্গফুটের ৩টি ফ্ল্যাট যার একেকটির মূল্য ৮০ লাখ টাকা। লালমাটিয়ায় ১৩০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট যার মূল্য ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। ইন্দিরা রোডে একটি ফ্ল্যাট কেনেন ৬৫ লাখ টাকায়। ঘনিষ্ঠ বন্ধুর নামে এটির বুকিং এবং অবশিষ্ট মূল্য পরিশোধ করেন। শান্তিনগরে কেনা হয় ১ কোটি ২৬ লাখ টাকার আরেকটি ফ্ল্যাট। এটির মূল্য তৌফিক তার ভাইয়ের নামে পরিশোধ দেখান। রাজধানীর নীলক্ষেতে আছে ২টি দোকান একসঙ্গে কেনা হয় ২ কোটি ২০ লাখ টাকায়। বিভিন্ন ব্যাংকে স্থায়ী আমানত (এফডিআর) রয়েছে ৬৪ লাখ টাকার।
অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, এই তিন কর্মকর্তার নেতৃত্বে সিন্ডিকেট করে পুরো অধিদফতর জুড়েই বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি করে রাখতেন। মহাপরিচালক, অতিরিক্ত মহাপরিচালকসহ অন্যান্য কর্মকর্তার আদেশ তাদের কাছে ছিল তুচ্ছ। এমনকি তারা বর্তমান মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন।
সূত্র জানায়, অধিদফতরের উচ্চপদস্থসহ আরও কয়েক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলাসহ বিভাগীয় ব্যবস্থা প্রক্রিয়া শুরু হবে।
সংবাদচিত্র ডটকম/দুদক