ফুটপাত ও ফুটওভার ব্রিজ— নগরজীবনের সবচেয়ে মৌলিক অবকাঠামো। কিন্তু ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের প্রায় সব বিভাগীয় শহরে এই ফুটপাত ও ফুটওভার ব্রিজ এখন প্রভাবশালী দখলদারদের নিয়ন্ত্রণে। ভ্রাম্যমাণ দোকান, অস্থায়ী ঘরবাড়ি আর ব্যবসার চাপে সাধারণ মানুষ বাধ্য হচ্ছেন মূল সড়কে নেমে চলতে, যা প্রতিদিনই বাড়াচ্ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি ও মানুষের ভোগান্তি। অথচ নীরব দর্শকের ভূমিকায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ— যেন জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষায় তাদের কোনো দায় নেই।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব বিভাগীয় শহরের ফুটপাত এখন আর পথচারীদের নয়; সেগুলো দখল করে নিয়েছে প্রভাবশালী দখলদার চক্র। ফুটপাত পরিণত হয়েছে অবৈধ বিপণি-বিতানে, যেখানে দিনরাত চলে জমজমাট ব্যবসা-বাণিজ্য। অথচ বাধ্য হয়ে পথচারীদের নামতে হচ্ছে মূল সড়কে— যা কেবল ভোগান্তিই নয়, প্রাণহানির ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।
দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা চললেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। প্রশাসনের উদাসীনতা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং শক্তিশালী সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায় সাধারণ মানুষ আজ ফুটপাত ব্যবহারের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।
নিরাপত্তার পরিবর্তে ঝুঁকির পথ
শহর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, ফুটপাত হলো পথচারীদের নিরাপদ চলাচলের অন্যতম মৌলিক অবকাঠামো। কিন্তু ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ মহানগরে ফুটপাত এখন দোকানদার, ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী এমনকি প্রভাবশালীদের আয়ের প্রধান উৎসে পরিণত হয়েছে।
গুলিস্তান, ফার্মগেট, নিউমার্কেট, মিরপুর, উত্তরা—ঢাকার কোনো এলাকাই এই দখলদারিত্বের বাইরে নয়। একই চিত্র দেখা যায় রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও রংপুরসহ সব বিভাগীয় শহরে। কোথাও দোকানপাট, কোথাও খাবারের স্টল, আবার কোথাও স্থায়ী ঘরবাড়িও গড়ে উঠেছে ফুটপাতের ওপর।
ফলে যানজট বৃদ্ধি, দুর্ঘটনার আশঙ্কা এবং পথচারীদের দৈনন্দিন দুর্ভোগ এখন নিত্যনৈমিত্তিক চিত্রে পরিণত হয়েছে।
‘প্রতিদিন মনে হয় দুর্ঘটনা ঘটবেই’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,
“ফুটপাত দিয়ে হাঁটার মতো জায়গা নেই। সব জায়গায় দোকান। বাধ্য হয়ে রাস্তায় হাঁটতে হয়। প্রতিদিন মনে হয় দুর্ঘটনা ঘটবেই।”
শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, নারী, শিশু ও বয়স্কদের জন্য পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। ব্যস্ত সময়ে সড়কের ফাঁকফোকর দিয়ে চলাচল করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনায় আহত হচ্ছেন অসংখ্য মানুষ।
দখলদার সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজি
তদন্তে জানা গেছে, ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করতে হলে নির্দিষ্ট অঙ্কের মাসিক ‘চাঁদা’ গুনতে হয়। এই চাঁদা চলে যায় স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসাধু সদস্য এবং দখলদার সিন্ডিকেটের পকেটে।
গুলিস্তানের এক দোকানদার জানান,
“আমরা এখানে বসে আছি ভাড়া দিয়েই। পুলিশ, নেতারা সবাই জানে। টাকা দিলে কোনো সমস্যা হয় না।”
আইন আছে, কার্যকর প্রয়োগ নেই
সিটি কর্পোরেশন, রাজউক ও পুলিশের নিয়মিত উচ্ছেদ অভিযানের পরও সমস্যার সমাধান মিলছে না। কিছুদিন পরই ফুটপাত আবারও পুরনো রূপে ফিরে আসে। নগরবাসীর মতে, এসব অভিযান মূলত ‘লোক দেখানো’ পদক্ষেপে পরিণত হয়েছে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় প্রতিদিন যানজটের কারণে প্রায় ৩৫ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, যার অন্যতম কারণ ফুটপাত দখল। এই ক্ষতি সরাসরি দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
নারী ও শিশুরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে
নিরাপদ ফুটপাত না থাকায় নারী ও শিশুরা বাধ্য হয়ে মূল সড়কে হাঁটছেন, যেখানে দুর্ঘটনার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি, অতিরিক্ত ভিড়ের মধ্যে নারীরা প্রায়ই যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিশেষজ্ঞদের মত
শহর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন,
“ফুটপাত হলো একটি নগরের মৌলিক জনঅধিকার। কিন্তু রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ফুটপাত দখল হয়ে যাচ্ছে। এটি শুধু প্রশাসনিক দুর্বলতা নয়, নগর ব্যবস্থাপনার ভয়াবহ ব্যর্থতা।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান মনে করেন,
“রাষ্ট্র যদি জনগণের মৌলিক অধিকার—নিরাপদে চলাচলের অধিকার—রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে মানুষের মনে রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি আস্থা নষ্ট হয়। ফুটপাত দখল সেই ব্যর্থতার প্রতীক।”
অপরাধের আস্তানা
দখলকৃত ফুটপাত বহু জায়গায় অপরাধীদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে। মাদক ব্যবসা, ছিনতাই ও চাঁদাবাজির মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চলে এসব স্থানে, যা নগরবাসীর জন্য আরও বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপের দাবি
রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরের ফুটপাত আজ সাধারণ মানুষের নয়, বরং একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, প্রশাসনের অদক্ষতা ও দুর্নীতির চক্র ভাঙা না গেলে ফুটপাত কোনোদিনই পথচারীদের জন্য উন্মুক্ত হবে না।
আইন, সংবিধান ও নগর ব্যবস্থাপনার মূল নীতিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে—ফুটপাত পথচারীদের জন্য। কিন্তু বাস্তবে চিত্র ঠিক উল্টো, আর সেই উল্টো চিত্রের ভার বহন করছে প্রতিদিনের নগরবাসী।
সংবাদচিত্র ডটকম/ফিচার