ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রেমিক যুগলের বিরুদ্ধে ভয়াবহ ও সুপরিকল্পিত প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, আর প্রতারণার ধরণ দেখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব—সবাই বিস্মিত।
অভিযুক্তরা হলেন জান্নাতুল ফেরদৌস শ্রাবণী, উর্দু বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী ও কবি সুফিয়া কামাল হলের আবাসিক ছাত্রী এবং রাকিবুজ্জামান শুভ, দর্শন বিভাগের একই সেশনের শিক্ষার্থী, যিনি কবি জসীম উদ্দীন হলে থাকেন। তাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ২৮টি প্রতারণার অভিযোগ জমা পড়েছে বলে নিশ্চিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
প্রতারণার শুরু শ্রাবণীর পরিচিত এক শিক্ষার্থী জুলফা আক্তারের পরিচয় ব্যবহার করে। “বৃত্তির আবেদন” এর কথা বলে শ্রাবণী তার কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র, ছবি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজ সংগ্রহ করেন। এরপর জুলফার নামে একটি ভুয়া ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্ট খুলে সিলেটের বন্যার সময়ে ফেসবুকে করুণ গল্প ও ছবি পোস্ট করে বিভিন্ন জনের সহানুভূতি আদায় করেন এবং মোবাইল অর্থ লেনদেন সেবার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করতে থাকেন।
এইভাবে, শুধুমাত্র একটি ঘটনায়ই ৩০ হাজার টাকার বেশি হাতিয়ে নেন তিনি। ভুক্তভোগীদের মধ্যে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সহকারী প্রক্টর, সাধারণ শিক্ষার্থী এবং আমেরিকা প্রবাসী একজন প্রাক্তন ছাত্র।
তদন্তে উঠে এসেছে, কল্যাণ তহবিল, বিভিন্ন দাতব্য সংগঠন, এমনকি ব্যক্তিগতভাবে সহানুভূতিশীল শিক্ষক-কর্মকর্তার কাছ থেকেও একাধিক পরিচয়ে টাকা নিয়েছেন শ্রাবণী। কখনও জুলফা, কখনও আয়েশা, আবার কখনও নিজের মাকে ‘গৃহপরিচারিকা’ পরিচয়ে ব্যবহার করে টাকা উত্তোলন করেছেন।
একপর্যায়ে ‘পে ইট ফরওয়ার্ড’, ‘মোরাল প্যারেন্টিং’, ‘শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন’, ‘বসুন্ধরা শুভসংঘ’, এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কাছ থেকেও অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণ তহবিল থেকেও শ্রাবণী দুইবারে মোট ৭০ হাজার টাকা তুলেছেন— একবার নিজের নামে, আরেকবার ভুয়া পরিচয়ে।
তদন্তে জানা যায়, প্রতারণার এই চক্রের মূল সংগঠক ছিলেন রাকিবুজ্জামান শুভ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরে ঘুরে কল্যাণ তহবিলের কাগজপত্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন ‘সেটআপ’ করতেন তিনি। নিজের নামেও তিনি কল্যাণ তহবিল থেকে ৩০ হাজার টাকা তুলেছেন।
এছাড়া “ব্যবসা করব” বলে শিক্ষার্থী ও সহপাঠীদের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। ভূগোল বিভাগের শিক্ষার্থী মুসা রায়হান, সলিমুল্লাহ হলের ফয়েজ আহমেদ, সাবেক শিক্ষার্থী শাহিন হোসেনসহ একাধিক জনের কাছ থেকে মোট ৬০ হাজার টাকারও বেশি সংগ্রহের অভিযোগ উঠেছে।
একাধিক ভুক্তভোগী জানিয়েছে, শুভ প্রথমে বন্ধুত্ব স্থাপন করে, তারপর ব্যবসার অংশীদার বানানোর প্রস্তাব দিয়ে টাকা নেয় এবং এরপর কোনো যোগাযোগ রাখে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর অফিস জানায়, এ পর্যন্ত ২৮টি লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। সহকারী প্রক্টর শারমীন কবীরকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত চলমান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক সালমা নাসরিন বলেন, “আমাদেরকে এ বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে। শিক্ষার্থীর মানসিক অবস্থা বিবেচনায় তাকে আপাতত হলে রাখা হয়েছে। তদন্তের ফলাফলের ভিত্তিতে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
প্রক্টর অধ্যাপক ড. সাইফুদ্দিন বলেন, “যেহেতু একাধিক ভুক্তভোগীর অভিযোগ রয়েছে, বিষয়টি আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি রক্ষায় প্রমাণসাপেক্ষে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এমনকি, জুলাই আন্দোলনের ‘ভুয়া যোদ্ধা’ পরিচয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের কাছ থেকে পুরস্কারও আদায় করেছে। গ্রুপে পোস্ট করে মেসের বুয়াকে আহত সাজিয়ে টাকা তুলেছেন, দিয়েছেন সুস্থ হওয়ার খবর, উপহার দিয়েছেন মোবাইল, ছাগল ও বৃত্তিও।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সংগঠন ইতোমধ্যে তাদের সদস্যপদ বাতিল করেছে। ‘গ্রিন ফিউচার ফাউন্ডেশন’ ও ‘পে ইট ফরোয়ার্ড’ সংগঠনগুলো জানিয়েছে, তারা প্রতারণার তথ্য প্রমাণ পাওয়ার পরপরই শ্রাবণী ও শুভকে বহিষ্কার করেছে। তবে অর্থ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা অন্ধকারাচ্ছন্ন।
সংবাদচিত্র ডটকম/অপরাধ