দুই কোটিরও বেশি মানুষের শহর রাজধানীতে মানুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গাড়ি, কিন্তু রাস্তা বাড়ানোর সুযোগ না থাকায় নগরবাসীর নিত্যসঙ্গী যানজট। রাজধানীর যানজট এড়ানোর বিকল্প হতে যাচ্ছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। কোনো সিগন্যাল বা বাধা ছাড়াই উড়ালসড়ক দিয়ে বিমানবন্দর থেকে আসা যাবে ফার্মগেট। উড়ালসড়ক খুলে দিলে বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট যাওয়া-আসা করতে সময় লাগবে মাত্র ১০ মিনিট। সরকারের আশা, পুরো প্রকল্পটি চালু হলে রাজধানীর যানজট অনেকটাই কমে আসবে। পাশাপাশি কমবে ভ্রমণ খরচ, বাঁচবে সময়।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, ‘এই উড়ালসড়ক দিয়ে তেজগাঁও হয়ে হলি ক্রসের পাশ দিয়ে খামারবাড়িতে নামবে। ধানমন্ডি, লালমাটিয়া, মোহাম্মদপুর যাওয়া-আসা যারা করেন, তারা কিন্তু বেনিফিটেড হতে পারেন। একই সঙ্গে আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটা যদি হয়ে যায়, তাহলে কিন্তু ঢাকাকে বাইপাস করার জন্য এটি একটি চমৎকার ব্যাকবোন হতে পারত।’
বাধাহীন যাত্রার নতুন এই পথ পেতে যাচ্ছেন রাজধানীবাসী। দেশের প্রথম ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একাংশ কাল (শনিবার) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করবেন যান চলাচলের জন্য।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মূল অংশের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। উড়ালসড়কে ওঠানামার জন্য মোট ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ৩১টি র্যাম্প রয়েছে। র্যাম্পসহ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মোট দৈর্ঘ্য ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। তবে আপাতত বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত সাড়ে ১১ কিলোমিটার খুলে দেয়া হচ্ছে। এই অংশে ওঠানামার র্যাম্পসহ মোট দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে ২২ কিলোমিটার। এই সাড়ে ১১ কিলোমিটার প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পরের দিনই যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে।
সেতু বিভাগ জানিয়েছে, শনিবার বেলা সাড়ে ৩টা নাগাদ প্রথমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিমানবন্দর অংশে একটা ফলক উন্মোচন করবেন। এরপর টোল দিয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ওপর দিয়ে বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট হয়ে পুরাতন বাণিজ্য মেলার মাঠে আসবেন। সেখানে সুধী সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। সমাবেশে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে বক্তব্য রাখবেন তিনি।
সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন বলেন, ‘উড়ালসড়কে কোনো ট্রাফিক কিংবা সিগন্যাল থাকবে না, শুধু রোড সাইন দেখে যানবাহন চলাচল করতে পারবে। ফলে যানজট ছাড়াই নির্বিঘ্নে চলাচলের সুযোগ থাকবে। যেহেতু রাজধানীতে ১১ কিলোমিটার নতুন পথ তৈরি হলো, এতে একটানে বিমানবন্দর থেকে গাড়িগুলো ফার্মগেটে নেমে যাবে, ফলে ফার্মগেট একটু যানজট হতে পারে। তবে সবাই আইন মেনে চললে এবং এনফোর্সমেন্টে যথাযথ হলে সেটিও এড়ানো সম্ভব হবে। তা ছাড়া প্রতিটি এন্ট্রি পয়েন্টে টোলবুথ থাকবে। উড়ালসড়ক দিয়ে উঠে যেখানেই নামুক না কেন, গাড়িভেদে টোল ৮০ থেকে ৪০০ টাকা দিতে হবে।’
উদ্বোধন হতে যাওয়া বিমানবন্দর-ফার্মগেট অংশের অংশে ওঠানামার জন্য মোট ১৫টি র্যাম্প (এয়ারপোর্ট-২, কুড়িল-৩, বনানী-৪, মহাখালী-৩, বিজয় সরণি-২ ও ফার্মগেট-১) রয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি র্যাম্প যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। বনানী-১১ নম্বর এবং মহাখালী এই দুটি র্যাম্প কিছুদিন পরে চালু হবে।
সুধী সমাবেশে ৫ হাজার জন দাওয়াত পেয়েছেন
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দুটি ভাগে বিভক্ত। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সেতু বিভাগের পক্ষ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার অতিথিকে দাওয়াত দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সেতুসচিব। এর বাইরেও পুরাতন বাণিজ্য মেলার খোলা মাঠে জনসমাবেশে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা আসবেন।
এর আগে আগারগাঁওয়ে জনসভার প্রস্তুতি উপলক্ষে এক মতবিনিময় সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘২ সেপ্টেম্বর রাজধানী মহাসমুদ্র দেখবে, জনতার মহাসমুদ্র। সেই মহাসমুদ্র দেখার অপেক্ষায় আছি।’
উড়ালসড়কে উঠবে যেসব যানবাহন
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে যানবাহনের গতি সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে শনিবার উদ্বোধনের পর উড়ালসড়কে যানবাহন সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারবে বলে জানিয়েছে সেতু বিভাগ। পুরোপুরি চালু হওয়ার পরই সর্বোচ্চ গতিতে গাড়ি চলতে পারবে।
সেতু বিভাগ জানিয়েছে, উড়ালসড়কটিতে সব ধরনের যানবাহন চলবে না। দুর্ঘটনার ঝুঁকি শূন্যে নিয়ে আসতে উচ্চগতির যানবাহনের জন্য নির্ধারিত এই পথে স্বল্পগতির বাহন যেকোনো থ্রি-হুইলারের চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একই সঙ্গে মোটরসাইকেল, মোটরবাইক ও বাইসাইকেলের মতো বাহনের চলাচল নিষিদ্ধ করেছে সরকার। উড়ালসড়কে পথচারীও চলাচল করতে পারবেন না।
২৪ ঘণ্টা খোলা থাকবে, দিতে হবে টোল
দেশের এই উড়ালসড়কে রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা যান চলাচলে খোলা থাকবে। তবে যান চলাচলে দিতে হবে সরকার নির্ধারিত টোল। ইতোমধ্যে টোলও নির্ধারণ হয়ে গেছে। ফলে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে চলাচল করা যানবাহন থেকে চার ক্যাটাগরিতে টোল আদায় করা হবে। এর মধ্যে ক্যাটাগরি-১-এ থাকছে কার, ট্যাক্সি, জিপ, স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিক্যাল, মাইক্রোবাস (১৬ সিটের কম) ও হালকা ট্রাক (তিন টনের কম), এ ক্ষেত্রে টোল দিতে হবে ৮০ টাকা। ক্যাটাগরি-২-এ থাকছে মাঝারি ট্রাক (ছয় চাকা পর্যন্ত), এ ক্ষেত্রে টোল দিতে হবে ৩২০ টাকা। ক্যাটাগরি-৩-এ থাকা ট্রাকের (ছয় চাকার বেশি) জন্য দিতে হবে ৪০০ টাকা। ক্যাটাগরি-৪-এ সব ধরনের বাসের (১৬ সিট বা তার বেশি) জন্য ১৬০ টাকা টোল নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রকল্পের কাজ এখনো বাকি
প্রথম ধাপে বিমানবন্দরের দক্ষিণ কাওলা থেকে বনানী রেলস্টেশন পর্যন্ত, দ্বিতীয় ধাপে বনানী রেলস্টেশন থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত কাজ হয়েছে। আর তৃতীয় ধাপে মগবাজার লেভেল ক্রসিং থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত নির্মাণকাজ এখনো চলছে। তৃতীয় ধাপের বেশির ভাগ কাজই এখনো বাকি। প্রকল্প এলাকায় কিছু জায়গায় কেবল পিলার বসানোর কাজ চলছে। প্রকল্পের তৃতীয় ধাপের নির্মাণকাজের অগ্রগতি হয়েছে ৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ। তবে প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৬৫ শতাংশ।
এদিকে মগবাজার লেভেল ক্রসিং থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত নির্মাণকাজ আগামী ২০২৪ সালের জুনে শেষ করার লক্ষ্য সংশ্লিষ্টদের। সে সময় পুরো পথে একসঙ্গে যানবাহন চলতে পারবে।
৩ বছরের কাজ ১৩ বছরেও হলো না
ঢাকা শহরের উত্তর থেকে দক্ষিনে নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য ২০১১ সালের জুনে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজের উদ্বোধন হয়েছিল। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) আওতায় প্রকল্পটির ২০১৬ সালে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু উড়ালসড়কের নকশা বদল, ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা, অর্থের সংস্থানসহ নানা জটিলতায় নির্মাণকাজ শেষ করার সময়সীমা পাঁচবার পিছিয়েছে। প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন শেষে উড়ালসড়কের নির্মাণকাজ শেষ করার প্রথম সময়সীমা ছিল ২০১৭ সাল। সেটি পিছিয়ে হয় ২০১৮। তারপর আবার পিছিয়ে হয়েছে ২০২২ সাল। এই সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় চতুর্থবার সে সময়সীমা পিছিয়ে দাঁড়ায় ২০২৩ সালের জুনে। তবে সর্বশেষ পুরো প্রকল্পের কাজ ২০২৪ সালের জুনে শেষ করার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
এদিকে শুরুতে উড়ালসড়ক নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ৮ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকায়। এরপর কাজের ধীরগতির সঙ্গে বাড়তে থাকে প্রকল্পের মেয়াদ।
২৫ বছর পর মালিকানা পাবে সরকার
ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (এফডিইই) কোম্পানি লিমিটেড হচ্ছে বিনিয়োগকারী কোম্পানি। এতে ইতালিয়ান থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেডের ৫১ শতাংশ, চায়না শানডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপের (সিএসআই) ৩৪ শতাংশ এবং সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেডের ১৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।
প্রকল্প সূত্র বলছে, প্রকল্পটি পিপিপির আওতায় বিনিয়োগকারীর সঙ্গে সরকারের চুক্তি হয়েছে ২৫ বছরের। সাড়ে তিন বছর নির্মাণকাজ শেষে বাকি সাড়ে ২১ বছর টোল আদায় করবে বিনিয়োগকারী অংশীদার প্রতিষ্ঠান। তারপর এর মালিকানা পুরোপুরি বুঝে পাবে সরকার।
সংবাদচিত্র ডটকম/বিশেষ সংবাদ