বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার একটি গ্রামে বাদ্যযন্ত্র বাজানো, হিজড়া এবং হকার নিষিদ্ধ করে নোটিশ দেয়া হয়েছে। গত প্রায় পাঁচ-ছয়দিন ধরে গ্রামের বিভিন্ন স্থানে সাঁটানো এই নোটিশের ছবি ছড়িয়ে পড়লে এটি ঘিরে তোলপাড় চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
বাদ্যযন্ত্র বাজালে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে ওই নোটিশে।
তবে স্থানীয় প্রশাসন বলছে গ্রামের বিভিন্ন স্থানে সাঁটানো একশ টাকার নন – জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পের এই নোটিশটি আইন বহির্ভূত।
গত কয়েক মাস ধরেই বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে লালন আখড়া ও মাজারে হামলা, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাধা বা বন্ধ করে দেওয়ার একাধিক ঘটনা ঘটেছে।
ঝিনাইদহের ঘটনায় হরিণাকুণ্ডু থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। এরই মধ্যে গতকাল সোমবার থেকে প্রশাসন নোটিশ অপসারণের কাজ করছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বি এম তারিক উজ জামান জানিয়েছেন, কারা এবং কোন উদ্দেশ্যে এই নোটিশ দিয়েছে সে বিষয়ে তদন্ত চলছে।
তবে গ্রামটিতে এর আগে কখনো হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সম্পর্কে কোন ঘটনা ঘটেছে বা অভিযোগ রয়েছে এমন কোন তথ্যও নেই বলে জানিয়েছেন তারিক উজ জামান।
নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে- গ্রামবাসীর পক্ষে সকল প্রকার বাদ্যযন্ত্র ও হকার নিষিদ্ধকরণের এই নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
এই নোটিশে স্বাক্ষরকারীদের একজন শড়াতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মাশিউর রহমান।
বিবিসি বাংলাকে তিনি জানান, উচ্চ শব্দ এবং ডিজে পার্টি হওয়ার কারণেই গ্রামবাসী এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে কথা বলে এ বিষয়ে সমাধান করা হবে।
নোটিশে যা বলা হয়েছে
ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুণ্ডু উপজেলার শড়াতলা গ্রামের বিভিন্ন স্থানের দেয়ালে গত কয়েকদিন বেশ কিছু নোটিশ সাঁটানো ছিল।
নন– জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পের এই নোটিশের শিরোনাম সকল প্রকার বাদ্যযন্ত্র ও হকার নিষিদ্ধকরণের নোটিশ।
গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে।
শড়াতলা গ্রামে সকল প্রকার বাদ্যযন্ত্র নিষিদ্ধ করা হয়েছে উল্লেখ করে এতে বলা হয়েছে, যারা বাদ্যযন্ত্র বাজাবে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একইসাথে চার হাজার টাকা জরিমানা করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে নোটিশে।
শুধু তাই নয় নোটিশ অমান্যকারীদের বাবা-মা’ এর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়া গ্রামে সকল প্রকার হকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
একইসাথে হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদেরও গ্রামে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বলে এই নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে।
“যেহেতু আমাদের গ্রাম ৯৫ শতাংশ শিক্ষিত ও ২০ জনের মত সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী আছে। নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ বিবেচনা করে গ্রামবাসী এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে” বলে উল্লেখ করা হয়েছে নোটিশে।
এই নোটিশের শেষে গ্রামবাসীর পক্ষে ১৯ জনের স্বাক্ষর হাতে লেখা রয়েছে।
স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে শড়াতলা গ্রামের পশ্চিম-পাড়া মসজিদের সভাপতি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, স্থানীয় দোকানদার, মসজিদের ইমাম, বিএনপির স্থানীয় কমিটির সভাপতি, ডিগ্রী কলেজের শিক্ষক, স্থানীয় প্রশাসনের মেম্বার, ব্যবসায়ী এবং দলিল লেখক রয়েছেন।
এই স্বাক্ষরকারীদেরই একজন শড়াতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মাশিউর রহমানকে সাংবাদিক পরিচয় দিলে প্রথমে এ বিষয়ে কোন কথা বলতে চাননি।
এ বিষয়টি নিয়ে খুবই বিপদে রয়েছেন বলে জানান মাশিউর রহমান।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “আমরা একদম অজপাড়া গাঁয়ে থাকি। চাষী ফ্যামিলির ছেলে। এ বিষয় নিয়ে খুব বিপদে আছি। এটা সবাই মিলেই করছে, কিন্তু আমার গায়ে চলে আসছে সব।”
গ্রামটিতে গান-বাজনার কোন রেওয়াজ নেই বললেই চলে জানিয়ে মাশিউর রহমান বলেন, “এখানে গান-বাজনার কিছু নাই। কোন শিল্পীও নাই আমাদের। এখানে কোন গান-বাজনাও হয় না। এখানে হয় উচ্চ শব্দ। এখানে হয় ডিজে পার্টি। ডিজে পার্টি আসে, উচ্চ শব্দ হয় মাঝে-মধ্যেই।”
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে আজ মঙ্গলবার দুপুরে আলোচনা (মিটিং) হয়েছে জানিয়ে মাশিউর রহমান বলেন, এ সমস্যার সমাধান করা হবে। তবে গ্রামে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ কেন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সে বিষয়ে আর কোন কথা বলতে চাননি এই স্কুল শিক্ষক।
স্থানীয় প্রশাসন যা বলছে?
হরিণাকুণ্ডু উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা বি এম তারিক উজ জামান বিবিসি বাংলাকে জানান প্রশাসনিকভাবে এ ধরনের কোন সিদ্ধান্তই হয়নি।
তারিক উজ জামান বলেন, ” প্রচলিত আইনে প্রশাসন থেকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার নেই। এটা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত নয়। প্রাথমিক তদন্তে পাওয়া গেছে এটা শড়াতলা গ্রামের কতিপয় ব্যক্তি যারা ওখানে স্বাক্ষর করেছে তাদের ব্যক্তিগত অভিমতের আলোকে তারা এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।”
এ বিষয়ে এরই মধ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে থানায় একটি জিডি (সাধারণ ডায়েরি) করা হয়েছে।
ওই নোটিশের কপিসহ প্রশাসনিকভাবে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চিঠিও দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তারিক উজ জামান।
একইসাথে ওই চিঠিতে কি কি ব্যবস্থা নিতে হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে।
“যে পোস্টারগুলা সাঁটানো হয়েছে সেগুলো অপসারণ করতে হবে। জড়িত যারা তাদেরকে যথাযথ তদন্ত-পূর্বক কেন করেছে সে কারণ উদঘাটন করে তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার প্রক্রিয়ায় যেতে হবে এবং সার্বিকভাবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ” বলেন তারিক উজ জামান।
এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কারো কোন উস্কানি রয়েছে কিনা সেটিও খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তারিক উজ জামান।
গান–বাজনা বন্ধ করাই এই নোটিশের উদ্দেশ্য ছিল কিনা সেটি তদন্ত শেষ হওয়ার পরই জানা যাবে বলে জানিয়েছেন এই সরকারি কর্মকর্তা।
এরই মধ্যে আজ মঙ্গলবার সকাল থেকেই হরিণাকুণ্ডু থানা এবং ঝিনাইদহ ডিবি পুলিশের দুইটি টিম শড়াতলা গ্রামে এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে।
এখন পর্যন্ত এ গ্রামে হিজড়া বা গান–বাজনা সংক্রান্ত কোন অভিযোগ পেয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নে তারিক উজ জামান জানান, “এ ধরনের কোন কিছু সম্পর্কে আমি অবগত না। গত ১৮ই নভেম্বর আমি হরিণাকুণ্ডুতে যোগদান করেছি। এখানে আসার পরে এ ধরনের কোন ইস্যু আমার নজরে আসেনি। এমন কোন ঘটনাও ঘটেনি”।
সাম্প্রদায়িক কোন ইস্যু তৈরির আশঙ্কাসহ সবগুলো বিষয়ই খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান স্থানীয় প্রশাসনের এই সরকারি কর্মকর্তা তারিক উজ জামান।
দুপুরে স্থানীয় মানুষরা এই সরকারি কর্মকর্তার সাথে নোটিশের বিষয়ে দেখা করতে গেলে তাদেরকে লিখিতভাবে জানাতে বলেছেন এই সরকারি কর্মকর্তা।
দুই ধরনের নোটিশ কেন ?
স্থানীয় সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, গত কয়েক দিনে যেসব নোটিশ সাঁটানো হয়েছে সেগুলোর মধ্যে দুই ধরনের নোটিশ দেখা গেছে।
এর মধ্যে কিছু নোটিশে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তির স্থানে লেখা টিএনও। পাশেই মোবাইল নাম্বার লেখা রয়েছে। আবার গ্রামের স্থানীয় বাজারের দোকানসহ বিভিন্ন স্থানে সাঁটানো নোটিশে স্বাক্ষরকারীর তালিকার এক নম্বর কারো নাম নেই, কিছু লেখা নেই। ফাঁকা রয়েছে ওই স্থান।
নোটিশের এক নম্বরে টিএনও লেখা থাকলেও এখন বাংলাদেশে থানা নির্বাহী কর্মকর্তা নেই, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা কাজ করেন।
হরিণাকুণ্ডু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বি এম তারিক উজ জামান বিবিসি বাংলাকে জানান গতকাল সোমবারই এই নোটিশের বিষয়ে জানতে পেরেছেন তিনি। এতে তার নাম ব্যবহার করা রহস্যজনক বলে মন্তব্য করেন তারিক উজ জামান।
কারণ কিছু নোটিশে নম্বর দেয়া হয়েছে আবার কিছু নোটিশে ওই জায়গাটি ফাঁকা রয়েছে বলে বাংলাদেশের একটি টেলিভিশনে দেখেছেন বলে জানান এই সরকারি কর্মকর্তা।
তারিক উজ জামান বলেন, ” শড়াতলা গ্রামের বিভিন্ন জায়গাতে পোস্টারিং আকারে যেসব ফটোকপি সাঁটানো হয়েছে সেগুলোতে আমার নাম্বার ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু মূল কপিতে দেখেছি আমার নাম্বারটা নেই”।
“বিষয়টা রহস্যজনক যে একটা কপিতে নাম্বার নাই, আবার যে কপিগুলো ছড়িয়ে, ছিটিয়ে পড়েছে তাতে কে বা কারা চক্রান্ত করে নাম্বারটা ছড়িয়ে দিয়েছে” বলেন তারিক উজ জামান।
বিনা অনুমতিতে একজন সরকারি কর্মকর্তার সরকারি মোবাইল নাম্বার কেন নোটিশে ব্যবহার করা হয়েছে সে কারণেই এই জিডি করা হয়েছে বলে জানান এই সরকারি কর্মকর্তা।
স্থানীয় গণমাধ্যমের একজন সাংবাদিক আজ মঙ্গলবার ওই গ্রামে গিয়েছেন।
বিবিসি বাংলাকে তিনি জানিয়েছেন, দুপুরে তিনি পৌঁছার পর সেখানে আর কোন নোটিশ দেখেননি তিনি।
হরিণাকুণ্ডু উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা বি এম তারিক উজ জামান দুপুরে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন গতকাল সোমবার থেকেই নোটিশগুলো প্রশাসনের পক্ষ থেকে তুলে ফেলা হয়েছে। সূত্র: বিবিসি বাংলা
সংবাদচিত্র ডটকম/সারাদেশ