জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই)-এর শীর্ষ পদে নিয়োগ প্রক্রিয়াকে ঘিরে তুমুল আলোচনা চলছে। আগামী নভেম্বরে বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী অবসরে গেলে ওই পদে বসতে যাচ্ছেন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মো. শফিকুল হাসান।
অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র ও প্রাপ্ত নথিপত্রের ভিত্তিতে জানা গেছে, শফিকুল হাসানের বিরুদ্ধে রয়েছে বহু কোটি টাকার দুর্নীতি, অনিয়ম, ঘুষ বাণিজ্য ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ।
ছাত্রলীগ থেকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে
গোপালগঞ্জের সন্তান শফিকুল হাসান কুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আওয়ামী লীগ আমলে রাজনৈতিক যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে দ্রুত প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন তিনি। একাধিক কর্মকর্তার অভিযোগ—“গোপালগঞ্জ কানেকশন” ব্যবহার করে তিনি ডিপিএইচই-এর বড় বড় প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণ নেন, আর এই সুযোগেই গড়ে ওঠে দুর্নীতির সাম্রাজ্য।
পার্বত্য অঞ্চলে পানি প্রকল্প: দুর্নীতির সিস্টেমেটিক চিত্র
২০২৩ সালে এডিবির অর্থায়নে চালু হওয়া পার্বত্য অঞ্চলে পানি সরবরাহ প্রকল্পটির সময়কাল পাঁচ বছর। কিন্তু প্রকল্প সূত্র জানাচ্ছে, দুই বছর পার হলেও প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ৩ শতাংশ।
একটি অভ্যন্তরীণ নথি অনুযায়ী, কনসালটেন্ট নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ৬ কোটি টাকা ঘুষের মাধ্যমে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেন শফিকুল হাসান। প্রায় সাড়ে ১,১০০ কোটি টাকার এই প্রকল্পে কেনাকাটা, আউটসোর্সিং নিয়োগ এবং অন্যান্য খরচে “তুঘলকি কান্ড” ঘটেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রকল্পের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “আউটসোর্সিং নিয়োগে প্রতিটি পদে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়া হয়েছে। বিল-ভাউচারে দেখানো হয়েছে শত শত পণ্যের নাম, কিন্তু মাঠপর্যায়ে কিছুই সরবরাহ করা হয়নি।”
গত দুই বছরে প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৩৫ কোটি টাকা, কিন্তু উন্নয়নমূলক কাজ কার্যত হয়নি। সূত্র বলছে, এই অর্থের সিংহভাগ পিডির পকেটে গেছে। প্রকল্পের টেন্ডার প্রক্রিয়াতেও শফিকুলের ৫ শতাংশ কমিশন (পিসি) নেওয়ার স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। শুধু এই প্রকল্প থেকেই তিনি ১৫ কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছেন বলে ধারণা।
গোপালগঞ্জ প্রকল্পে অর্থ লোপাট
গোপালগঞ্জ জেলা পানি সরবরাহ প্রকল্পেও একই ধরণের দুর্নীতি চক্রের প্রমাণ মিলেছে। নথি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রকল্পের অফিস ডেকোরেশনে প্রকৃত ব্যয়ের চেয়ে চার গুণ বেশি খরচ দেখানো হয়েছে। নিয়োগ, কেনাকাটা ও টেন্ডার বাণিজ্যে এখান থেকেও হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে ৩০-৩৫ কোটি টাকা।
এই প্রকল্পের বড় অংশের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করেছেন স্থানীয় ঠিকাদার কামাল শিকদার, যিনি শফিকুল হাসানের আত্মীয় এবং গোপালগঞ্জের প্রভাবশালী ঠিকাদার হিসেবে পরিচিত। কামালের মালিকানাধীন জে কে পলিমার ফ্যাক্টরি থেকে নিম্নমানের পাইপ সরবরাহ করেও পূর্ণাঙ্গ বিল তোলা হয়েছে। প্রকল্পের ভেতরের এক কর্মকর্তা বলেন, “পাইপের বাইরের গায়ে মান বজায় রাখলেও ভেতরে থিকনেস কমিয়ে সস্তা পাইপ সরবরাহ করা হয়েছে।”
বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ
একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে, শফিকুল হাসানের স্ত্রী ও সন্তানরা যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। সেখানেই রয়েছে বাড়ি, ফ্ল্যাট ও দামি গাড়ি। ঢাকায় তাঁর নামে রয়েছে তিনটি ফ্ল্যাট, আর গোপালগঞ্জে একাধিক একর জমি। অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্প থেকে হাতিয়ে নেওয়া টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করা হয়েছে বিদেশে।
একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, “মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা শফিকুলের যে সম্পদের পাহাড় দাঁড়িয়েছে, তা বৈধ কোনো আয়ে সম্ভব নয়।”
শীর্ষপদে বসার লবিং
বর্তমান প্রধান প্রকৌশলীর অবসরের পর শীর্ষপদ নিশ্চিত করতে এখন জোর লবিংয়ে নেমেছেন শফিকুল হাসান। বিভিন্ন গোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা ও আর্থিক প্রলোভন দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। ডিপিএইচই-এর এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “টাকা শফিকুলের জন্য কোনো সমস্যা নয়। তিনি যেকোনো মূল্যে এই পদ চান।”
অভ্যন্তরীণ সূত্রের মতে, প্রধান প্রকৌশলী হতে পারলে শফিকুল আরও অন্তত ৩০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার সুযোগ পাবেন।
তদন্তের দাবি
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অভ্যন্তরে অনেক কর্মকর্তা মনে করছেন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে শফিকুল হাসানের অতীত কার্যক্রমের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত জরুরি। এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এই পদে তাঁকে বসানো হলে দুর্নীতির মাত্রা আরও বেড়ে যাবে, আর প্রকল্পগুলোর কাজ সম্পন্ন হওয়ার আশা থাকবে না।”
সংবাদচিত্র ডটকম/অনুসন্ধান প্রতিবেদন