বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ উন্নয়ন সংস্থা ‘স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর’ (এলজিইডি) দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের মূলে এক নিরব, নিরলস বিপ্লব ঘটিয়েছে। গ্রামীন সড়ক, স্কুল, ব্রিজ, বাজার, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে শহরের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণে এর অবদান অনস্বীকার্য।
১৯৮০ সালে যাত্রা শুরু করা এই সংস্থাটির নেতৃত্বে ছিলেন এবং আছেন যেসব প্রধান প্রকৌশলী, তাদের কাহিনিই আজকের এই ফিচার প্রতিবেদন।
একটি উন্নয়নশীল প্রতিষ্ঠানের উত্তরণের ইতিহাস
প্রথমে পল্লী পূর্ত কর্মসূচি নামে যাত্রা শুরু করে ১৯৮৪ সালে এটি ‘স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইবি)’ নামে পরিচিত হয় এবং ১৯৯২ সালের ৩১ আগস্ট এটি পূর্ণাঙ্গ অধিদপ্তর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে—স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর বা এলজিইডি।
এ সংস্থার প্রথম প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন প্রয়াত কামরুল ইসলাম সিদ্দিক। প্রায় ১৬ বছর ধরে তিনি দক্ষতার সঙ্গে এলজিইডিকে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করান। তার হাত ধরেই এলজিইডি ঢাকা আগারগাঁওয়ে নিজস্ব ভবনে স্থানান্তরিত হয়। এলজিইডির ইতিহাসে তিনিই সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রধান প্রকৌশলী (১৮ বছর ১০ মাস)।
নানামাত্রিক নেতৃত্ব: গৌরব, বিতর্ক এবং পরিবর্তনের কাহিনি
এই দীর্ঘ সময়ে এলজিইডির শীর্ষপদে এসেছেন ১৮ জন প্রধান প্রকৌশলী। কেউ কেউ অবদান রেখেছেন নীরবে, কেউ আবার আলোচনায় এসেছেন নানা বিতর্কে।
মোঃ সহিদুল হাসান যিনি প্রায় ৮ বছর দায়িত্ব পালন করেন, তিনি এলজিইডির “আইকন” হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত।
মোঃ ওয়াহিদুর রহমান একদিকে যেমন দীর্ঘ সময় দায়িত্বে ছিলেন (৫ বছর ১১ মাস), অন্যদিকে তার বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতির অভিযোগ এবং এক কেলেঙ্কারির অভ্যন্তরীণ বিস্ফোরণ এলজিইডির ইতিহাসে বড় দাগ ফেলেছে।
শ্যামা প্রসাদ অধিকারী গোপালগঞ্জের রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী হন। তবে, দুর্বল নেতৃত্ব ও কর্মচারীদের সাথে দূরত্ব তাকে বিতর্কিত করে তোলে।
মোঃ আবুল কালাম আজাদ, মোঃ খলিলুর রহমান, ও মোঃ রশীদ খান– এদের সময়কালে এলজিইডির ক্ষমতা কাঠামো ও নিয়োগ ব্যবস্থায় নানা অনিয়মের অভিযোগ শোনা গেছে। বিশেষত, খলিলুর রহমানের ছেলের নাম ভাঙিয়ে সয়েল টেস্ট ব্যবসা, রশীদ খানের ভাইয়ের আউটসোর্সিং নিয়োগ বাণিজ্য ইত্যাদি প্রশ্ন তোলে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার স্বচ্ছতা নিয়ে।
বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের দিকে তাকিয়ে
বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) মোঃ আব্দুর রশীদ মিয়া গত ৪ জানুয়ারি দায়িত্ব নেন। দেশের চলমান এক অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে তিনি সাহসিকতার সঙ্গে এ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এমতাবস্থায় অত্যন্ত ধৈর্য্য, বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার সঙ্গে সবদিক সামলে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন। যদিও তার নিয়োগকে ঘিরে সিনিয়রিটি লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে, তিনি চলতি বছরের আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবেন।
মো. আবদুর রশীদ মিয়ার মেয়াদ শেষে এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন যথাক্রমে- আনোয়ার হোসেন, জাবেদ করিম এবং শেখ মোঃ নূরুল ইসলাম। তবে যেহেতু অধিকাংশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ বা আইনি জটিলতা রয়েছে, তাই ভবিষ্যতের নেতৃত্ব নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।
একটি প্রতিষ্ঠান, একাধিক গল্প
এলজিইডির ইতিহাসে কিছু প্রধান প্রকৌশলী নিজেদের দক্ষতা, সততা এবং দূরদর্শিতার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন, যেমন— কামরুল ইসলাম সিদ্দিক বা সহিদুল হাসান। আবার কিছু ব্যক্তির কর্মকাণ্ড প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে এলজিইডির এতো বছর ধরে টিকে থাকা এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে উন্নয়নের ছোঁয়া পৌঁছে দেওয়ার পেছনে এর কর্মীদের পাশাপাশি নেতৃত্বের ভূমিকাও অপরিসীম।
উপসংহার
একটি প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বই সেই প্রতিষ্ঠানকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়, অথবা টেনে ধরে রাখে। এলজিইডির ৪৪ বছরের ইতিহাসে দুই ধরনের উদাহরণই রয়েছে। তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটির কর্মজীবনের শক্তি, অভিজ্ঞতা এবং দেশের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা। ভবিষ্যতের নেতৃত্ব কেমন হবে, তা হয়তো সময়ই বলে দেবে, তবে অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া এখন জরুরি।
সংবাদচিত্র ডটকম/জাতীয়