আকাশে ওড়ার প্রতীক ছিল এআই ১৭১ ফ্লাইটটি—একটি আধুনিক বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার, গন্তব্য লন্ডন। কিন্তু স্বপ্নভঙ্গ হলো উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যেই। পাইলটের ‘মে-ডে’ সংকেতের পর বিমানটি আচমকাই নেমে আসে আহমেদাবাদের মেঘানিনগরের আবাসিক এলাকায়। দগ্ধ ধ্বংসাবশেষ আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ধোঁয়া যেন ঘোষণা করল—এয়ার ইন্ডিয়ার ট্র্যাজেডির ইতিহাসে যোগ হলো আরও একটি কালো অধ্যায়।
১২ জুন ২০২৫, একটি তারিখ যা এয়ার ইন্ডিয়ার ইতিহাসে নতুন করে রক্তাক্ত দাগ টেনে দিল।
এআই ১৭১ ফ্লাইটের এই মর্মান্তিক বিপর্যয়ে এখন পর্যন্ত ২০৪ জনের বেশি মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে, রয়টার্স জানিয়েছে।
তবে এই দুর্ঘটনা কোনো ব্যতিক্রম নয়—এটি একটি দীর্ঘ, বেদনাদায়ক ধারাবাহিকতার অংশ। গর্বের প্রতীক এয়ার ইন্ডিয়ার পেছনে লুকিয়ে রয়েছে মর্মান্তিক ইতিহাস—দুর্ঘটনা, মানবিক ভুল, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা আর সন্ত্রাসী হামলার গল্প। স্বাধীনতার আগ থেকে শুরু হওয়া এই পথে প্রায় ১৩০০ জনের বেশি প্রাণ ঝরেছে, যার প্রতিটিই বুকে কষ্টের ছাপ এঁকে গেছে।
এয়ার ইন্ডিয়া: উত্থান ও গৌরব
১৯৩২ সালে জে আর ডি টাটার হাত ধরে ‘টাটা এয়ারলাইনস’ হিসেবে যাত্রা শুরু করে যা ১৯৫৩ সালে সরকারি মালিকানায় এয়ার ইন্ডিয়া নামে রূপান্তরিত হয়। প্রথম এশিয়ান এয়ারলাইন হিসেবে বোয়িং ৭৪৭ ও পরে ৭৮৭ ড্রিমলাইনার ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানটি প্রযুক্তির দিক থেকেও পথিকৃত ছিল। লোগোয় ব্যবহৃত ময়ূর প্রতীকটি ভারতীয় সংস্কৃতির পরিচায়ক।
তবুও, সব অর্জনের ছায়ায় রয়েছে এমন এক ইতিহাস, যা একের পর এক প্রাণহানির দুঃখগাঁথা।
বিপর্যয়ের ধারাবাহিকতা: কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা
১৯৪৭ | করাচি: এয়ার ইন্ডিয়ার এক ফ্লাইট দুর্ঘটনায় নিহত ২৩ জন
১৯৫০ | ফ্রান্সের মঁ ব্লঁ: ফ্লাইট ২৪৫ বিধ্বস্ত—৪৮ জন নিহত
১৯৬৬ | আল্পস দুর্ঘটনা: ফ্লাইট এআই ১০১ ধ্বংস, ১১৭ জনের মৃত্যু। ড. হোমি ভাবার মৃত্যু ভারতের পরমাণু গবেষণায় অপূরণীয় ক্ষতি
১৯৭৮ | আরব সাগরে পতন: বোয়িং ৭৪৭–২১৩ জন প্রাণ হারান
১৯৮۵ | কানিষ্কা ট্রাজেডি: ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য বিমানবোমা হামলায় ৩২৯ জনের মৃত্যু
১৯৮৮ | আহমেদাবাদ: ফ্লাইট ১১৩ বিধ্বস্ত—১৩৩ জন নিহত
২০১০ | মঙ্গলুরু: টেবিলটপ রানওয়ে বিপর্যয়—১৫৮ জনের প্রাণহানি
২০২০ | কোঝিকোড: এআই এক্সপ্রেস IX ১৩৪৪ রানওয়ে ওভারশুট করে বিধ্বস্ত—২১ জনের মৃত্যু
২০২৫ | মেঘানিনগর: এআই ১৭১ ড্রিমলাইনার ধ্বংস—২০০’র বেশি প্রাণহানি
গর্ব আর গ্লানির দ্বৈত ইতিহাস
প্রতিটি দুর্ঘটনা শুধু পরিসংখ্যান নয়, প্রতিটি মৃত্যু একটি পরিবার, একটি গল্প। এয়ার ইন্ডিয়ার ইতিহাস শুধুই এক বিমান সংস্থার নয়; এটি ভারতের প্রযুক্তিগত উত্থান, মানবিক ভুল, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস এবং অপ্রতিরোধ্য শোকের দলিল।
এয়ার ইন্ডিয়া হয়তো ভারতীয় আকাশপথের প্রতীক, কিন্তু এর ডানায় আঁকা প্রতিটি রঙিন স্বপ্নের পেছনে লুকিয়ে আছে শোকের ছায়া। প্রশ্ন থেকে যায়—এতসব অভিজ্ঞতার পরও, আমরা কি সত্যিই প্রস্তুত প্রতিটি যাত্রাকে নিরাপদ করার জন্য?
তথ্যসূত্র: এয়ার ইন্ডিয়ার অফিসিয়াল ওয়েবসাইট, টাইমস অব ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান টাইমস, এনডিটিভি, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ও আইসিএও রিপোর্টস