কবি জীবনানন্দ দাশের ৬৯তম প্রয়াণ দিবস আজ। ১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর কলকাতার বালিগঞ্জে এক ট্রাম দুর্ঘটনায় তিনি গুরুতর আহত হন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২২ অক্টোবর কলকাতার শম্ভুনাথ হাসপাতালে মৃত্যু হয় তার।
ঘটনার দিন ট্রামের ক্যাচারে আটকে তার শরীর দলিত হয়ে গিয়েছিল। ভেঙ্গে গিয়েছিল কণ্ঠ, ঊরু এবং পাঁজরের হাড়। গুরুতরভাবে আহত জীবনানন্দের চিৎকার শুনে ছুটে এসে নিকটস্থ চায়ের দোকানের মালিক চূণীলাল এবং অন্যান্যরা তাঁকে উদ্ধার করে। তাঁকে ভর্তি করা হয় শম্ভূনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে। এ সময় ডা. ভূমেন্দ্র গুহ-সহ অনেক তরুণ কবি জীবনানন্দের সুচিকিৎসার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। কবি-সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাস এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর অনুরোধেই পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায় কবিকে দেখতে এসেছিলেন এবং আহত কবির সুচিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছিলেন যদিও এতে চিকিৎসার তেমন উন্নতি কিছু হয়নি।
তবে জীবনানন্দের অবস্থা ক্রমশ জটিল হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন কবি। চিকিৎসক ও সেবিকাদের সকল প্রচেষ্টা বিফলে দিয়ে ২২শে অক্টোবর, ১৯৫৪ তারিখে রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।
১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন আধুনিক বাংলা কবিতার পঞ্চপাণ্ডবের অন্যতম কবি জীবনানন্দ দাশ। বাবা সত্যানন্দ দাশ ছিলেন মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক। মা কুসুম কুমারী দাশও ছিলেন কবি। যার রচিত ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’- পঙক্তি দুটি আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। সাংসারিক কাজের ফাঁকে তিনি কবিতা লিখতেন। জীবনানন্দ দাশ সাহিত্যচর্চা ও কবিতা রচনার প্রেরণা পান মায়ের কাছ থেকেই।
১৯২৫ সালের জুনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে জীবনানন্দ দাশ রচনা করেন ‘দেশবন্ধুর প্রয়াণে’, যা প্রকাশিত হয় ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকায়। তবে ১৯৫২ সাল থেকে তার কবিতা নিয়মিত ‘প্রবাসী’, ‘বঙ্গবাসী’, ‘কল্লোল’, ‘কালি-কলম’, ‘বিজলী’, ‘ধূপছায়া’, ‘প্রগতি’ প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশ পেতে থাকে। কবির কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘ঝরা পালক’, ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, ‘বনলতা সেন’, ‘মহাপৃথিবী’, ‘সাতটি তারার তিমির’, ‘রূপসী বাংলা’ এবং ‘বেলা অবেলা কালবেলা’। এ ছাড়া তিনি ‘কবিতার কথা’ শিরোনামে একটি গদ্যগ্রন্থও লিখেছেন। জীবনানন্দের মৃত্যুর পর ছাপা হয় তার উপন্যাস ‘মাল্যবান’ ও ‘সতীর্থ’। এ ছাড়াও তার অপ্রকাশিত অনেক রচনা পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত হয়েছে।
জীবনানন্দ দাশ ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক এবং অধ্যাপক। তাকে বাংলাভাষার “শুদ্ধতম কবি” বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অগ্রগণ্য। মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ধাপে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন এবং ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে যখন তার জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছিল ততদিনে তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম কবিতে পরিণত হয়েছেন।
তিনি প্রধানত কবি হলেও বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা ও প্রকাশ করেছেন। তবে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে অকাল মৃত্যুর আগে তিনি নিভৃতে ২১টি উপন্যাস এবং ১০৮টি ছোটগল্প রচনা করেছিলেন যার একটিও তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি।
তাঁর জীবন কেটেছে চরম দারিদ্রের মধ্যে। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধকালে অনপনেয়ভাবে বাংলা কবিতায় তাঁর প্রভাব মুদ্রিত হয়েছে। রবীন্দ্র-পরবর্তীকালে বাংলা ভাষার প্রধান কবি হিসাবে তিনি সর্বসাধারণ্যে স্বীকৃত। তাকে বাংলাভাষার শুদ্ধতম কবি অভিধায় আখ্যায়িত করা হয়েছে।
সংবাদচিত্র ডটকম/শিল্প ও সাহিত্য