ভয়াবহ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম পাইকারি কাপড়ের বাজার বঙ্গবাজার মার্কেট। প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা জ্বলে মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে নিয়ন্ত্রণে এসেছে আগুন। তবে তার আগেই পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে হাজার হাজার ব্যবসায়ীর সম্বল। বিধ্বংসী এই অগ্নিকাণ্ডের খবর দেশীয় গণমাধ্যমের পাশাপাশি উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও।
আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে কেন বেগ পেতে হল?
আগুন লাগার কিছুক্ষণের মধ্যেই ভোর ৬টা ১০মিনিটে খবর পায় দমকলকর্মীরা। কিন্তু বঙ্গবাজারের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা লাগার পেছনে তিন প্রতিবন্ধকতার কথা বলেছে ফায়ার সার্ভিস। মঙ্গলবার দুপুরে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, সকাল ৬টা ১০ মিনিটে আগুন লাগে। দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এখন আর আগুন ছড়াবে না। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ৫০টি ইউনিট কাজ করেছে। তবে পুরোপুরি নির্বাপণ করতে আরও কিছু সময় লাগবে। প্রতিটি ভবন ও ঘরে গিয়ে আগুন আছে কি না, তা পরীক্ষা করতে হবে।
মহাপরিচালক বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে প্রধান বাধা ছিল উৎসুক জনতা। পানির স্বল্পতা ও বাতাসের কারণেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে দেরি হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় উৎসুক জনতার আচরণে দুঃখপ্রকাশ করে বলেন, উৎসুক জনতার কারণে কাজ করতে সমস্যা হয়েছে।
এরপর আগুন নেভাতে পানির স্বল্পতার কথা বলেন মহাপরিচালক মো. মাইন উদ্দিন। তিনি বলেন, সেনাবাহিনী পানির বাউজার এনে এবং ওয়াসাও পানির বিষয়ে সহায়তা করেছে। আর ঘটনাস্থলে অনেক বাতাস ছিলো। বাতাসে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় আগুন চলে যায়। এর ফলে নিয়ন্ত্রণে আনতে দেরি হয়েছে।
বঙ্গবাজার ঝুঁকিপূর্ণ, নোটিশ দেওয়া হয়েছিল ১০ বার
২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল বঙ্গবাজারকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল উল্লেখ করে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন জানান, বঙ্গবাজারকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে এখানে ব্যানার টানানো হয় এবং ১০ বার নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারপরও ব্যবসায়ীরা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
আগুনের পেছনে কোন নাশকতা আছে কিনা খতিয়ে দেখা হবে
বঙ্গবাজারের আগুনের ঘটনায় নাশকতা রয়েছে কি না ফায়ার সার্ভিসের তদন্তে উঠে এলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
মঙ্গলবার (৪ এপ্রিল) দুপুর ৩টার দিকে পুলিশ সদর দপ্তরে সংবাদিকদের সাথে আলাপকালে আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, বঙ্গবাজারের আগুনের সময় ফায়ার সার্ভিসের সদরদপ্তরে হামলার ঘটনায় হামলাকারীদের চিহ্নিত করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরে হামলা প্রসঙ্গে পুলিশ প্রধান বলেন, আপনারা দেখেছেন কী অবস্থা, এখানে হাজার হাজার মানুষ। হামলার খবর পেয়ে আমরা সাথে সাথেই গিয়েছি, এরপর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছি। পরে জড়িতদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আইজিপি আরো বলেন, ইতোমধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। নাশকতার কোনো ঘটনা থাকলে কমিটির তদন্তে বের হয়ে আসবে। আমরা সেই রিপোর্টের অপেক্ষায় থাকবো। সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবশ্যই নেবো।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঘটনাটা যখন ঘটেছে, আগে থেকে প্রস্তুতি ছিলো না। আস্তে আস্তে আমরা শক্তি বৃদ্ধি করেছি, পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছি। এখন পুরো পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাও ঠিক রেখেছি, যার কারণে এত বড় ঘটনার পরও ঢাকার ট্রাফিক সচল ছিল।
আইজিপি বলেন, আমরা ভোর বেলায় আগুনের খবর পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে ছুটে এসেছি। পৌনে সাতটার মধ্যে সকল সিনিয়র অফিসাররা ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যোগ দেন। আমরা এসে মারাত্মক আগুন দেখি, ফায়ার সার্ভিস চারদিক থেকে কাজ করছে।
‘আমরাও রাজারবাগ থেকে ৫টা ওয়াটার ক্যানন এনে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কাজ শুরু করি। আমাদের ওয়াটার রিজার্ভার থেকে প্রায় ২ লাখ লিটার পানি সাপ্লাই দিয়েছি, আমাদের প্রায় ২ হাজার ফোর্স এই এলাকায় দায়িত্ব পালন করেছে।’
ফয়ার সার্ভিসের কর্মীরা অত্যন্ত পরিশ্রম করেছে। র্যাব-বিজিবিসহ তিন বাহিনীর সদস্যরা একযোগে দায়িত্ব পালন করেছে। সবকিছু মিলিয়ে আমরা কিছুক্ষণ আগে আগুন নিয়ন্ত্রণের খবর পেয়েছি, বলেন আইজিপি।
পুলিশ সদর দপ্তরে আগুন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের একটি ব্যারাকে আগুন লেগেছে। আমাদের সকল সদস্যরা নিরাপদে বের হতে পেরেছেন। মালামাল বের করতে পারিনি। তবে ডকুমেন্টস ও মালামালের কী কী ক্ষতি হয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে হবে।
উল্লেখ্য, দেশে কাপড়ের অন্যতম প্রধান মার্কেট বঙ্গবাজার। ভোরে লাগা আগুনে যখন মার্কেটটি পুড়ছিল- তখন নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছিল ফায়ার সার্ভিস। ঠিক এসময়টাতেই কিছু উশৃঙ্খল মানুষ হামলা চালায় ফায়ার সার্ভিসের সদরদপ্তরে। তারা গাড়িসহ অফিসের বিভিন্ন জায়গায় ভাঙচুর চালায়।
পুড়েছে পাঁচ হাজার দোকান, ক্ষতি দুই হাজার কোটি টাকার: মালিক সমিতি
বঙ্গবাজারের আড়াই হাজারসহ আশপাশের মার্কেটের আরও প্রায় আড়াই হাজার দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে দাবি করেন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন। সকালে রাজধানীর বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের প্রায় ৫ হাজার দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির এই সভাপতি।
বঙ্গবাজারের আড়াই হাজারসহ আশপাশের মার্কেটের আরও প্রায় আড়াই হাজার দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে দাবি করেন দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন।
অগ্নিদুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে তিনি বলেন, আগুনে আনুমানিক দুই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে থোক বরাদ্দ হিসেবে ৭০০ কোটি টাকা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন দোকান মালিক সমিতির সভাপতি।
তিনি বলেন, ‘আমাদের জানা মতে, শুধু বঙ্গবাজার কাঠের মার্কেটেই আড়াই হাজারের মতো দোকান রয়েছে। এখানে ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা দোকান করেন। সামনে ঈদ। সবাই ঈদকেন্দ্রিক বেচাকেনার পণ্য তুলেছেন দোকানে। এমন সময় এই অগ্নিকাণ্ড বড় ধরণের ক্ষতি ডেকে এনেছে।’
ব্যবসায়ী এ নেতা আরও বলেন, ‘এই ব্যবসায়ীদের পুঁজি বলতে দোকানের মালামালই। মালামাল পুড়ে গেলে তাদের আসলে পুঁজির পুরোটাই শেষ। এখন তাদের জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, রমজানের ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসায় ক্ষতি পুষিয়ে দিতে প্রাথমিকভাবে ৭০০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দের দেওয়া হোক।’
উল্লেখ্য বঙ্গবাজারে মঙ্গলবার সকাল ৬টা ১০ মিনিটে আগুন লাগার খবর পেয়ে ৬টা ১২ মিনিটে ঘটনাস্থলে যায় ফায়ার সার্ভিসের প্রথম ইউনিট। একে একে আগুন নিয়ন্ত্রণে যোগ দেয় ফায়ার সার্ভিসের আরও ৪৮টি ইউনিট। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিটে।
আগুনে ফায়ার সার্ভিসের ৫ সদস্যসহ আহত ১২
বঙ্গবাজারে আগুনের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের পাঁচ সদস্যসহ ১২ জন আহত হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে এসেছে। তাদের মধ্যে একজনকে শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক ইনস্টিটিউটে ও চার জনকে ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি করা হয়েছে। বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
আহত ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা হলেন- মেহেদি হাসান (২৮), রবিউল ইসলাম অন্তর (৩০), আতিকুর রহমান রাজন (৩৫), দিদারুল (৩২) ও বাবুল চক্রবর্তী (৫৮)। তাদের মধ্যে মেহেদিকে বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে।
আহত বাকিরা হলেন, নিলয় (৩৫), শাহিন (৪০), রিপন (৪০), রুবেল (৩২), দুলাল মিয়া (৬০), মো. সুমন মিজি (৪৮) ও মো. সোহেল। তারা বঙ্গবাজারের গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। তাদের মধ্যে নিলয়, শাহিন, রিপন ও রুবেলকে ঢামেকের জরুরি বিভাগে ভর্তি করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (৪ এপ্রিল) দুপুরে ঢামেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক মো. বাচ্চু মিয়া এ তথ্য জানান। তিনি জানান, ফায়ার কর্মী ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়েছেন এবং তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
সেনা, নৌ, বিমান বাহিনী এবং বিজিবি ও র্যাবের সদস্যরাও আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজে যোগ দেয়। বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে হাতিরঝিল থেকে পানি এসে ছিটানো হয়। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বলা হয় দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিটে ওই আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
বঙ্গবাজারের আগুনের সার্বক্ষণিক খবর রাখছেন প্রধানমন্ত্রী
বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সার্বিক খোঁজখবর রাখছেন এবং আগুন নিয়ন্ত্রণসহ সার্বিক কার্যক্রমের সমন্বয় করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব হাসান জাহিদ তুষার গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানান।
বঙ্গবাজারে আগুনের সূত্রপাত থেকেই সব বাহিনীর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে দিক নির্দেশনা দিতে থাকেন প্রধানমন্ত্রী। বঙ্গবাজার থেকে আশপাশের আরও চারটি মার্কেটে আগুন ছড়িয়ে পড়লে আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ৪৮টি ইউনিট কাজ করে। এক পর্যায়ে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে যোগ দেয় বিজিবি-বিমান-নৌ ও সেনাবাহিনী। তবে তাদের পানি সংকটে পড়তে হয়। পানি সংকটের কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হয়।
পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হল থেকে পানি নেওয়া হয়। দীর্ঘ পাইপে পানি নেওয়ার কারণে চাপ না থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে ব্যাঘাত ঘটেছিল। অন্যদিকে হাতিরঝিল থেকে পানি নেয় বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার। কয়েক দফায় হেলিকপ্টারে করে হাতিরঝিল থেকে পানি নেওয়া হয়েছিল।
সংবাদচিত্র ডটকম/দুর্ঘটনা