প্রকাশের সময়: বুধবার, ২৭ আগস্ট, ২০২৫ । ৭:০৯ অপরাহ্ণ প্রিন্ট এর তারিখঃ শুক্রবার, ৩ অক্টোবর ২০২৫

দ্রোহ, প্রেম ও সাম্যের কবি: জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম

রেজাউল করিম রেজা

আজ ২৭ আগস্ট, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৬ সালের এই দিনে তিনি চলে গিয়েছিলেন নীরব এক নিস্তব্ধতায়। কিন্তু তাঁর কলমের শব্দ, সুরের ঝংকার এবং চিন্তার বিদ্যুৎ আজও আমাদের জাগিয়ে রাখে। সময় বদলেছে, সমাজ বদলেছে, কিন্তু বদলায়নি নজরুল—তিনি আজও সমান প্রাসঙ্গিক, সমান প্রতিবাদী, সমান মানবতাবাদী।

এক অসাধারণ জীবনের শুরু
১৮৯৯ সালের ২৪ মে, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। দারিদ্র্যের কারণে শৈশবেই নানা দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। শিশু বয়সে কাজ করেছেন মসজিদে মুয়াজ্জিন হিসেবে, আবার কাজ করেছেন লেটোর দলে গানের মাধ্যমে। এই লেটো দলে কাজ করতে করতেই তিনি সঙ্গীত, নাটক, এবং কবিতার সঙ্গে গভীরভাবে মিশে যান।

পরবর্তীতে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং সৈনিক জীবনের অভিজ্ঞতা তাঁর লেখায় এক নতুন মাত্রা যোগ করে। ফিরে এসে সাংবাদিকতা শুরু করেন, লেখালেখির মধ্য দিয়ে হয়ে ওঠেন বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বলিষ্ঠ ও বিদ্রোহী কণ্ঠস্বর।

বিদ্রোহের কণ্ঠ
১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় নজরুলের কালজয়ী কবিতা “বিদ্রোহী”। এই কবিতা যেন ছিল বাংলা সাহিত্যের ঘুমন্ত চেতনার ওপর বজ্রাঘাত। এই কবিতার মাধ্যমেই নজরুল হয়ে ওঠেন “বিদ্রোহী কবি”। কবিতায় তিনি লিখেন—
“আমি চির বিদ্রোহী বীর
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!”

এই উচ্চারণ শুধু কাব্যিকই নয়, ছিল একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান। তৎকালীন ব্রিটিশ শাসন, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি—সব কিছুর বিরুদ্ধে এই কবিতায় ছিল একটি সাহসী প্রতিবাদ।

সাম্য ও মানবতার গান
নজরুল শুধুই বিদ্রোহ করেননি, তিনি মানুষকে ভালোবেসেছেন, বিশেষ করে নিপীড়িত, অবহেলিত, বঞ্চিত মানুষকে। তিনি গেয়েছেন সাম্যের গান—
“গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান।”

তিনি হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদের বিপক্ষে ছিলেন। তাঁর রচনায় বারবার উঠে এসেছে অসাম্প্রদায়িকতা, মানবতা এবং ভ্রাতৃত্ববোধ। তাঁর গানে যেমন শোনা যায় ইসলামী ভাবধারা, তেমনি শোনা যায় শ্যামাসঙ্গীত, কীর্তন ও বৈষ্ণব পদাবলীর প্রভাব।

এই কারণে কোনো একদল তাঁকে কট্টর মুসলমান বলে অভিযুক্ত করেছে, আবার আরেক দল বলেছে তিনি হিন্দুদের কাছাকাছি। কিন্তু নজরুল সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে বলেছিলেন—
“ধর্মের নামে আজ যত ব্যভিচার, আমি তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি।”

সাংবাদিকতা ও কারাবরণ
নজরুল শুধু সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। তিনি ‘ধূমকেতু’ নামক এক সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে লিখেছেন আগুন ঝরানো সব সম্পাদকীয়।
তাঁর “আনন্দময়ীর আগমনে” কবিতার জন্য তাঁকে গ্রেফতার করে ব্রিটিশ সরকার। কারাগারে বসেই তিনি রচনা করেন “রাজবন্দীর জবানবন্দী”—যা আজও প্রতিবাদের ম্যানিফেস্টো হয়ে রয়েছে।

কারাগারে অবস্থানকালেও তিনি অনশন শুরু করেন, প্রতিবাদ জানান কারার শোষণের বিরুদ্ধে। নজরুলের সাহস ছিল, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, সাহিত্যের দায়িত্ব কেবল সৌন্দর্য রচনা নয়, সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা।

সঙ্গীত সাধনায় বিপ্লব
নজরুলের আরেকটি অবিস্মরণীয় অবদান তাঁর সঙ্গীত রচনা ও সুরারোপ। প্রায় চার হাজারের মতো গান তিনি রচনা ও সুর করেছেন। এই গানগুলো আজ পরিচিত “নজরুলগীতি” নামে। তাঁর গানে যেমন আছে প্রেম, বিরহ, বিদ্রোহ, তেমনি আছে আধ্যাত্মিকতা ও দার্শনিকতা।

তিনি প্রথম বাঙালি মুসলমান যিনি বাংলা সংগীতকে এতটা সমৃদ্ধ করেছেন। বাংলা গানে তিনি নিয়ে এসেছেন গজল, কাওয়ালি, আরবি-ফারসি ধাঁচের সুর।

নিঃশব্দের দীর্ঘ প্রহর
১৯৪২ সালে নজরুল দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি হারান। তাঁর জীবনের শেষ ৩৪ বছর কেটেছে এক নীরব, নিঃসঙ্গ ঘেরাটোপে। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে নজরুলকে বাংলাদেশে আনা হয়। তাঁকে জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

১৯৭৬ সালের ২৭ আগস্ট ঢাকার পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন আমাদের এই মহান কবি।

আজকের প্রেক্ষাপটে নজরুল
নজরুল ছিলেন যিনি আগুনের ফুল ছুঁড়ে বলেছিলেন—
“জেগো ওঠো, অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও!”
আজ যখন সমাজে আবার ঘৃণা, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, বৈষম্য বাড়ছে—তখন নজরুল আমাদের জন্য আরও বেশি প্রয়োজনীয়। তাঁর শিক্ষা শুধু সাহিত্য নয়, সামাজিক আন্দোলন, নৈতিকতা, প্রতিবাদ এবং মানবিকতার পাঠ।

আমরা যদি নজরুলকে সত্যিকারভাবে স্মরণ করতে চাই, তবে শুধু শ্রদ্ধার্ঘ্য দিয়ে নয়, বরং তাঁর আদর্শ ধারণ করেই স্মরণ করতে হবে—
✔ অন্যায়ের বিরুদ্ধে দ্রোহ
✔ ধর্মীয় সহনশীলতা
✔ গরিব, নিপীড়িত মানুষের প্রতি ভালোবাসা
✔ নারীর মর্যাদা ও সমানাধিকারের দাবি
✔ সাহিত্য ও সঙ্গীতকে মানুষের মুক্তির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার

শেষ কথা
জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম চিরদিনের জন্য একটি আদর্শের নাম। তিনি আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি তথা জাতীয় চেতনাকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, তা অনন্য। আজ তাঁর ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা যেন প্রতিজ্ঞা করি—
“আমরা সেই বাংলাদেশ গড়ব, যেখানে থাকবে না বৈষম্য, ধর্মান্ধতা, নিপীড়ন—থাকবে কেবল মানুষে মানুষে ভালোবাসা, সমতা ও সম্মান।”

নজরুলের চেতনাই হোক আমাদের আলোর পথ।

লেখক: রেজাউল করিম রেজা
সিনিয়র সাংবাদিক ও সংগঠক

প্রিন্ট করুন