প্রকাশের সময়: সোমবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৫ । ৬:০৮ অপরাহ্ণ প্রিন্ট এর তারিখঃ শুক্রবার, ৩ অক্টোবর ২০২৫

ডিজিটাল হাজিরার নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ: প্রযুক্তি যেন ছায়া-স্বচ্ছতার মুখোশ

সৈয়দ কামরুজ্জামান

সারাদেশে চালু হওয়া ডিজিটাল হাজিরা সিস্টেম এখন দুর্নীতি, জবাবদিহির অভাব ও তথ্য-প্রবাহের সংকটে জর্জরিত। সাংবাদিকদের পথ রুদ্ধ, নাগরিক সেবা প্রতারিত।

বাংলাদেশে ‘ডিজিটাল রূপান্তর’ গত এক দশকে প্রযুক্তিনির্ভর প্রশাসনের আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে মাঠ প্রশাসনে চালু হওয়া ডিজিটাল হাজিরা সিস্টেম এখন রূপ নিচ্ছে এক মহা-প্রতারণার চক্রে। কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি, কাগুজে সফলতা, অথচ বাস্তব ব্যবস্থাপনায় ভর করেছে জট, অনিয়ম আর জবাবদিহির শূন্যতা। এর ফাঁদে আটকে আছে সাংবাদিকদের প্রশ্ন, আর ভোগান্তিতে পড়ছে সাধারণ নাগরিক।

প্রকল্পের কাগজে ‘স্মার্ট’, বাস্তবে ‘স্লিপেজ’

ডিজিটাল হাজিরা ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ছিল অফিস-শৃঙ্খলা ও উপস্থিতির স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। আধুনিক ডিভাইস বসিয়ে কেন্দ্রীয় সার্ভারে লগ পাঠানোর মাধ্যমে কে কখন অফিসে আসছে–যাচ্ছে, তা নির্ভুলভাবে সংরক্ষণের কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়:
• অনেক দপ্তরে ডিভাইস বসানোই হয়নি।
• বসানো হলেও মেশিন অল্প কিছুদিনের মধ্যেই অকেজো।
• কোথাও ইন্টারনেট নেই, কোথাও বিদ্যুৎ ঘনঘন যায়।
• লগ ডেটা সময়মতো আপলোড হয় না।
• ম্যানুয়ালভাবে হাজিরা ‘অ্যাডজাস্ট’ করা হয় কাগজে-কলমে।

এভাবে ডিজিটাল হাজিরা ব্যবস্থাটি হয়ে উঠেছে এক দ্বৈত বাস্তবতা—উপরের স্তরে প্রযুক্তির আলো, নিচে কেরানিপনার ছায়া।

সিন্ডিকেট, অতিমূল্যায়ন ও পুরোনো ডিভাইসের নতুন মোড়ক

সরবরাহকারী বাছাইয়ে রয়েছে ‘সীমিত প্রতিযোগিতা’ এবং সিন্ডিকেট সুবিধা:
• বাজার মূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে যন্ত্রপাতি ক্রয়।
• ‘রিফারবিশড’ ডিভাইসকে ‘নতুন’ হিসেবে দেখানো।
• প্রোপ্রাইটারি সফটওয়্যারের ফাঁদে ভেন্ডর লক-ইন।
• সফটওয়্যার লাইসেন্স ও সাপোর্ট ফি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বিল।
এসবই হচ্ছে স্বাধীন নিরীক্ষা ছাড়া— সরবরাহকারী যা দাবি করে, সেটিই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে সরকারি রিপোর্টে। ফলে, প্রকল্পের বাজেট ফুলে উঠছে, আর জবাবদিহি সঙ্কুচিত।

সাংবাদিকদের জন্য তথ্য যেন নিষিদ্ধ এলাকা

তথ্য সংগ্রহে সংবাদকর্মীরা বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন নিয়মিত:
• তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেও নির্ধারিত সময়ে তথ্য মিলছে না।
• “নিরাপত্তাজনিত কারণে প্রকাশযোগ্য নয়”—এই অজুহাতে তথ্য গোপন।
• অনেক সাংবাদিকের অ্যাক্রেডিটেশন ঝুলে গেছে।
• মাঠে গেলেও “উর্ধ্বতন অনুমতি”-র ঘূর্ণিপাকে ফেলা হয়।
জেলায়-উপজেলায় তো আরও ভয়াবহ— স্থানীয় প্রভাবশালীরা মৌখিকভাবে ‘সতর্ক’ করে দেন। ফলে নির্ভরযোগ্য তথ্য ছাড়াই রিপোর্ট করতে হচ্ছে সাংবাদিকদের, অথবা চুপ থাকতে হচ্ছে পেশাগত নিরাপত্তায়।

ডেটা স্বচ্ছ না হলে প্রযুক্তি প্রতারণার হাতিয়ার

বিশেষজ্ঞরা বলছেন— ডিজিটাল হাজিরার উদ্দেশ্য যদি হয় সময়ানুবর্তিতা ও দায়িত্ববোধ নিশ্চিত করা, তবে তার কেন্দ্রে থাকা উচিত:
• ইম্যুটেবল লগিং
• টাইমস্ট্যাম্পড এডিট ট্রেইল
• রোল-বেসড অ্যাক্সেস
• অ্যানোমালি ডিটেকশন
এই উপাদানগুলো ছাড়া ডিজিটাল হাজিরা কেবল ফাঁকা এক কাঠামো—যা দেখায় কিন্তু বলে না। স্বচ্ছতা যদি শুধু চেহারায় থাকে, ভিতরে যদি হেরফের হয়—তবে তা ছায়া-স্বচ্ছতা (Shadow Transparency)।

সুশাসনের প্রশ্নে বারবার ফাঁক

এই প্রকল্পের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন বিভিন্ন খাতের বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরা:

দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন:
“প্রযুক্তি ব্যবহারের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। কিন্তু প্রযুক্তির আড়ালে দুর্নীতি চললে এর প্রভাব আরও ভয়াবহ।”

অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মন্তব্য করেন:

“ডিজিটালাইজেশনের নামে প্রকল্প ব্যয় নিয়ন্ত্রণহীন হলে জনগণের করের টাকা অপচয় হয়।”

সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন:

“প্রকল্পে পর্যবেক্ষণ ও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা ছিল না বলেই এত অনিয়ম হয়েছে।”

নাগরিক সেবা প্রতারিত, ডিজিটাল ব্র্যান্ডিং প্রশ্নবিদ্ধ

ডিজিটাল হাজিরা ব্যবস্থার প্রথম ও প্রধান ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ:
• স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সিরিয়াল সিস্টেমে বিভ্রাট।
• ভূমি অফিসে কাগুজে সময়সূচি, বাস্তবে দীর্ঘ প্রতীক্ষা।
• বিদ্যালয়ে হাজিরা পূর্ণ, অথচ ক্লাসে ‘প্রক্সি’।
রাষ্ট্রীয় ‘স্মার্ট’ ব্র্যান্ডিং যখন বাস্তবে ম্যানুয়াল ওয়ার্ক-অ্যারাউন্ডের মুখোমুখি হয়, তখন নাগরিকদের আস্থা ভাঙে। রাজনৈতিকভাবে ঘোষিত ‘ডেলিভারি’ মাঠপর্যায়ে সত্য হয়ে উঠতে না পারলে নীতিনির্ধারণের সামাজিক লাইসেন্সও দুর্বল হয়ে পড়ে।

‘হাজিরা’ নয়, দরকার জবাবদিহির সংস্কৃতি

প্রশাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, হাজিরা মানেই পারফরম্যান্স নয়। প্রযুক্তি তো কেবল এক টুল—যদি সেটি:
• মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত না হয়,
• কাজের আউটপুট পরিমাপে ব্যবহৃত না হয়,
• এবং জবাবদিহিমূলক কাঠামোয় না থাকে,
তবে সেটি ব্যুরোক্র্যাটিক শেল—যার ভিতরে পুরোনো সংস্কৃতি অটুট থেকে যায়। অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকেও বিষয়টি চিন্তার: অপারেটিং খরচ বাড়ছে, কিন্তু পারফরম্যান্স-ইলাস্টিসিটি কমছে।

শেষ কথা: আয়না ধুলায় ঝাপসা, প্রতিচ্ছবি বিকৃত

ডিজিটাল হাজিরা একটি প্রযুক্তি-ভিত্তিক শাসনের প্রতীক হতে পারত। কিন্তু যখন সেটি পরিণত হয় ‘ডেটাবিহীন ফাইলচালনা’-য়, তখন তা প্রযুক্তির নামেই প্রতারণা। নাগরিকরা তখন শুধু কার্ড-ট্যাপের শব্দ শুনতে পান—প্রশাসনের কোনো উত্তর নয়। সাংবাদিকদের জন্য যখন তথ্য inaccessible হয়ে পড়ে, তখন রাষ্ট্রীয় নীরবতা জনআস্থার মৃত্যু ঘটায়।

সম্পাদকের নোট: এই প্রতিবেদন রাষ্ট্রীয় প্রকল্পে প্রযুক্তি ব্যবহারের নামে দুর্নীতির নির্ভরযোগ্য নথিপত্র ও মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা থেকে তৈরি। পাঠকের বিবেক এবং রাষ্ট্রের সংবেদনশীলতা জাগ্রত করাই এর মূল উদ্দেশ্য।

সংবাদচিত্র ডটকম/ফিচার

প্রিন্ট করুন