প্রকাশের সময়: সোমবার, ১৬ জুন, ২০২৫ । ১২:০৯ অপরাহ্ণ প্রিন্ট এর তারিখঃ মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫

হরমুজ প্রণালি বন্ধের হুমকি : দেশে জ্বালানি ও শিল্প খাতে বিপর্যয়ের আশঙ্কা

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি

মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যেই হরমুজ প্রণালি বন্ধের হুমকি দিয়েছে ইরান। এমনটি ঘটলে গোটা বিশ্বে জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থায় বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে বাংলাদেশের এলএনজি ও তেল আমদানি ব্যাহত হবে। যার ফলে বিদ্যুৎ, শিল্প, পরিবহন এবং সাধারণ জীবনযাত্রায় ব্যাপক প্রভাব পড়বে। তেল ও গ্যাসের দাম বাড়বে, বাড়বে পণ্যের মূল্য। আর এর চূড়ান্ত বোঝা পড়বে সাধারণ মানুষের কাঁধে।

হরমুজ প্রণালি মধ্যপ্রাচ্যের পারস্য উপসাগর ও ওমান উপসাগরকে সংযুক্ত করে, যা আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান প্রবাহ পথ। বিশ্বের প্রায় ২০ শতাংশ অপরিশোধিত তেল ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) এই সংকীর্ণ সমুদ্র পথ দিয়ে পরিবহন হয়। ইরান ও ওমানের মধ্যকার এ প্রণালীর সবচেয়ে সরু অংশ প্রায় ৩৩ কিলোমিটার চওড়া। এর সংকীর্ণতা ও অবস্থানের কারণে এটি ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার চরম কেন্দ্রবিন্দু। বিশ্বের শীর্ষ তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো এ রুট দিয়ে তাদের তেল রপ্তানি করে থাকে। তাই এ প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে বিশ্বজুড়ে তেলের সরবরাহে বড় ধরনের সংকট দেখা দেবে।

জানা যায়, ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত চলা ইরান-ইরাক যুদ্ধে উভয়পক্ষই উপসাগরীয় অঞ্চলে বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা চালিয়েছিল। তবে নানা সময় উত্তেজনা হলেও হরমুজ প্রণালি পুরোপুরি কখনো বন্ধ হয়নি।

বাংলাদেশের এলএনজি আমদানির প্রধান উৎস হিসেবে কাতার ও ওমান অন্যতম। পেট্রোবাংলার তথ্য মতে, কাতারের সঙ্গে বাংলাদেশের ১৫ বছরের ও ওমানের সঙ্গে ১০ বছরের এলএনজি আমদানির চুক্তি রয়েছে। চলতি অর্থবছরে কাতার থেকে ৪০টি এলএনজি কার্গো আসার কথা। যদিও ৩৪টি কার্গো ইতোমধ্যে বাংলাদেশে পৌঁছেছে। এসব এলএনজি কার্গোর অধিকাংশই হরমুজ প্রণালি হয়ে আসে।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) বিপণন বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের পর আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ায় বাংলাদেশেও আগামী মাস থেকে পেট্রোলিয়াম পণ্যদ্রব্যের দাম লিটারে ৪-৫ টাকা বৃদ্ধি পেতে পারে। হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে সরবরাহ ব্যবস্থায় বড় ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হবে এবং বাংলাদেশসহ অনেক আমদানিনির্ভর দেশে জ্বালানি সংকট দেখা দেবে।

বিশ্ববাজারে ইতোমধ্যে তেলের দাম উর্ধ্বমুখী। একদিনের ব্যবধানে অপরিশোধিত তেলের দাম প্রায় ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ব্যারেলপ্রতি প্রায় ৭৮ দশমিক ৫ ডলার ছুঁয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ উত্তেজনা দীর্ঘ স্থায়ী হলে তেলের দাম ১০০ থেকে ১৩০ ডলারে যেতে পারে।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য অনুসরণ করে মাসিক গড় দামের ভিত্তিতে তেলের দাম নির্ধারণ করি। বিষয়টি আমরা গুরুত্ব সহকারে পর্যবেক্ষণ করছি। যদি হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়, তবে লোহিত সাগর ও আরব সাগর ব্যবহার করে বিকল্প পরিবহন রুট বেছে নিতে হবে, যা জাহাজ ভাড়া ও পরিবহন খরচ বাড়াবে।

বাংলাদেশে এলএনজি ও তেল সরবরাহে হরমুজ প্রণালীর গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ রুট বন্ধ হলে দেশের গ্যাস সরবরাহে বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটতে পারে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্প খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্প এলএনজির ওপর নির্ভরশীল, তাই এর দাম বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে।

দেশের কয়েকটি ওশান গোয়িং শিপিং কোম্পানির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তেল সংকট ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাঁচামালের সংকটের কারণে বিদ্যুৎ সংকট ও লোডশেডিংয়ের শঙ্কা বেড়েছে। এর ফলে কলকারখানায় উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটতে পারে এবং তেলনির্ভর প্রতিষ্ঠানগুলোর খরচ বেড়ে যাবে। একইসঙ্গে পণ্য পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পাবে, যা সার্বিক মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী হবে। এসবের বোঝা সাধারণ মানুষকে বহন করতে হবে।

পোশাক খাতের অন্যতম উদ্যোক্তা ক্লিফটন গ্রুপের সিইও মো. মহিউদ্দিন চৌধুরী জানান, হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে কাতার থেকে এলএনজি আমদানি বিপন্ন হবে। জাহাজ পরিচালকরা নিরাপত্তার কারণে ওই রুট এড়াবেন কিংবা বীমার খরচ বেড়ে যাওয়ায় এলএনজির দাম আকাশছোঁয়া হবে। তাই বিকল্প পথে বা বিকল্প দেশ থেকে আমদানির ব্যবস্থা জরুরি।

বাংলাদেশ ফ্রেইট ফারোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট খায়রুল আলম সুজন বলেন, যদি ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ দীর্ঘায়ত হয় এবং আশপাশের সমুদ্রসীমা অরক্ষিত হয়, তাহলে হরমুজ প্রণালি বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। জাহাজগুলোকে বিকল্প পথে যেতে হবে, যার ফলে পরিবহন সময় ও ব্যয় উভয়ই বাড়বে। যদিও লোহিত সাগর রুট ঝুঁকিমুক্ত নয়, কারণ ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের হামলার কারণে এটি আগেও বন্ধ ছিল।

দেশের একমাত্র রিফাইনারি ইস্টার্ন রিফাইনারিতে বছরে প্রায় ১২-১৫ লাখ টন ক্রুড তেল পরিশোধন করা হয় জানিয়ে বিপিসির কর্মকর্তারা জানান, বিপিসির কাছে সর্বোচ্চ ৩৫ থেকে ৪০ দিনের জ্বালানি মজুত থাকে, যা প্রায় ৪ লাখ টন। এই মজুত কিছু সময়ের জন্য সংকট মোকাবিলায় সাহায্য করবে কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সংকটের ক্ষেত্রে বিকল্প পরিকল্পনা গ্রহণ করা আবশ্যক।

সংবাদচিত্র ডটকম/জাতীয়

প্রিন্ট করুন