প্রকাশের সময়: রবিবার, ১৪ মে, ২০২৩ । ১২:৫৬ অপরাহ্ণ প্রিন্ট এর তারিখঃ সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫

শতবর্ষে মৃণাল সেন

করিম রেজা

শতবর্ষে বাংলা সিনেমার বর্ষীয়ান নির্মাতা মৃণাল সেন। ১৯২৩ সালের ১৪ মে বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলা শহরের সদর এলাকার ঝিলটুলিতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ফরিদপুরে তিনি তার মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পড়ালেখা সম্পন্ন করে পশ্চিম বাংলার কলকাতায় স্থায়ী হন। পরবর্তীকালে তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্রের যুগ পরিবর্তনের অন্যতম কাণ্ডারি হয়ে ওঠেন। উপমহাদেশে সৎ ও চিন্তাশীল চলচ্চিত্রে তিনি অন্যতম পথিকৃৎ ব্যক্তিত্ব।

তাকে বলা হয় বাংলা চলচ্চিত্রের ‘ভুবন সোম’ । তার নির্মাণের ‘মৃগয়া’য় চড়ে বিশ্ব দরবারে বাংলা চলচ্চিত্র মর্যাদার আসন নিয়েছে। বাড়ির উঠান থেকে ময়দান, কানাগলি থেকে রাজপথ, বস্তি থেকে অট্টালিকা তার সিনেমায় এমন ভাবে উঠে এসেছে যা শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে আটকে না থেকে বৈশ্বিক রূপ ধারণ করেছে। আর এখানেই তার অনন্যতা।

চলচ্চিত্রের ‘নীল আকাশের নীচে’ ‘রাতভোর’ জেগে থাকা সারথী মৃণাল সেন। ১৪ মে। বাংলা সমান্তরাল সিনেমার পুরোধা ব্যক্তিত্বের ১০০তম জন্মদিন।

২৮টি পূর্ণদৈর্ঘ্য ও ৪টি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় ৬টি চলচ্চিত্র বিষয়ক মৌলিক গ্রন্থও লিখেছেন।

তার সিনেমায় বাম দর্শন বিশেষ ভাবে ফুটে ওঠে। তা সে ‘আকালের দর্শন’ হোক বা কলকাতা ট্রিলজি। ছাত্রাবস্থায় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক শাখার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। যদিও তিনি কখনো কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হননি। চল্লিশের দশকে তিনি সমাজবাদী সংস্থা আইপিটি-এর (ইন্ডিয়ান পিপ্‌লস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন) সঙ্গে যুক্ত হন এবং এর মাধ্যমে তিনি সমমনাভাবাপন্ন মানুষদের কাছাকাছি আসেন। আর তাই তার নির্মাণে সমাজতান্ত্রিক মনন ছায়া ফেলবে এটি স্বাভাবিক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে তিনি একজন সাংবাদিক, একজন ওষুধ বিপননকারী এবং চলচ্চিত্রে শব্দ কলাকুশলী হিসাবে কাজ করেন। কিন্তু তার মূল গন্তব্য ছিল চলচ্চিত্র নির্মাণ।

১৯৫৫ সালে মৃণাল সেনের প্রথম পরিচালিত ছবি ‘রাতভোর’ মুক্তি পায়। এই ছবিটি সাফল্য না পেলেও তার দ্বিতীয় ছবি ‘নীল আকাশের নীচে’ তাকে পরিচিতি এনে দেয়। তৃতীয় ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’ এনে দেয় প্রথম আন্তর্জাতিক খ্যাতি। ১৯৬৯ সালে তার পরিচালিত ছবি ‘ভুবন সোম’ মুক্তি পায়। বিখ্যাত অভিনেতা উৎপল দত্ত অভিনয় করেছিলেন সিনেমাটিতে। অনেকের মতে এটি মৃণাল সেনের শ্রেষ্ঠ ছবি। তার কলকাতা ট্রিলোজি অর্থাৎ ‘ইন্টারভিউ (১৯৭১)’, ‘ক্যালকাটা ৭১ (১৯৭২)’ এবং ‘পদাতিক (১৯৭৩)’ ছবি তিনটির মাধ্যমে তিনি তৎকালীন কলকাতার অস্থির অবস্থাকে তুলে ধরেছিলেন। মধ্যবিত্ত সমাজের নীতিবোধকে মৃণাল সেন তুলে ধরেন তার খুবই প্রশংসিত দুটি ছবি ‘এক দিন প্রতিদিন (১৯৭৯)’ এবং ‘খারিজ (১৯৮২)’ এর মাধ্যমে। ‘খারিজ’ ১৯৮৩ সালের কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ জুরি পুরস্কার পেয়েছিল।

১৯৮০ সালে আসে চলচ্চিত্র ‘আকালের সন্ধানে’। চলচ্চিত্র কলাকুশলীদলের একটি গ্রামে গিয়ে ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের দুর্ভিক্ষের উপর একটি চলচ্চিত্র তৈরির কাহিনী ছুঁয়ে গিয়েছিল পুরো চলচ্চিত্র বিশ্ব। কিভাবে ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষের কাল্পনিক কাহিনী মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় সেই গ্রামের সাধারণ মানুষদের সাথে সেটাই ছিল এই চলচ্চিত্রের সারমর্ম। সিনেমাটি ১৯৮১ সালের বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ জুরি পুরস্কার হিসাবে রুপোর ভালুক জয় করে। মৃণাল সেনের পরবর্তী সময়ের ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘খন্ডহর (১৯৮৪) ‘মহাপৃথিবী (১৯৯২)’ এবং ‘অন্তরীন (১৯৯৪)’। তার নির্মাণে শেষ সিনেমা ‘আমার ভুবন’ মুক্তি পায় ২০০২ সালে।

বাংলা ভাষা ছাড়াও হিন্দি, ওড়িয়া ও তেলেগু ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। ১৯৬৬ সালে ওড়িয়া ভাষায় নির্মাণ করেন মাটির মনীষ, যা কালীন্দিচরণ পাণিগ্রাহীর গল্প অবলম্বনে নির্মিত হয়। ১৯৬৯ এ বনফুলের কাহিনী অবলম্বনে হিন্দি ভাষায় নির্মাণ করে ‘ভুবন সোম’। ১৯৭৬ সালে নির্মাণ করে ‘মৃগয়া’। এ সিনেমায় মিঠুন চক্রবর্তীর অভিষেক ঘটে। ১৯৭৭ সালে প্রেম চন্দের গল্প অবলম্বনে তেলেগু ভাষায় নির্মাণ করেন ‘ওকা উরি কথা’। ১৯৮৫ সালে নির্মাণ করেন ‘জেনেসিস’। যা হিন্দি, ফরাসি ও ইংরেজি তিনটি ভাষায় তৈরি হয়।

মৃণাল সেন পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলি প্রায় সবকটি বড় চলচ্চিত্র উৎসব থেকে পুরস্কার জয় করেছে। ভারত এবং ভারতের বাইরের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেছে। তিনি ইন্টারন্যাশন্যাল ফেডারেশন অফ দি ফিল্ম সোসাইটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৮১ সালে তিনি ভারত সরকার দ্বারা পদ্মভূষণ পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৫ সালে তিনি দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পান। তিনি ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ অবধি ভারতীয় সংসদের সাম্মানিক সদস্যপদ লাভ করেন। ফরাসি সরকার তাকে কমান্ডার অফ দি অর্ডার অফ আর্টস অ্যান্ড লেটারস সম্মানে সম্মানিত করেন। এই সম্মান ফ্রান্সের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান। ২০০০ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাকে অর্ডার অফ ফ্রেন্ডশিপ সম্মানে ভূষিত করেন।

বাংলাভাষার বিশ্ববরেণ্য এই চলচ্চিত্রকারের শতবর্ষের বিশেষ এই দিনে তাকে ও তার চলচ্চিত্রকে নানাভাবে স্মরণের উদ্যোগ নিয়েছেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠন। এরমধ্যে অন্যতম ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি। এছাড়া সপ্তাহব্যাপী মৃণাল উৎসবের আয়োজন করেছে শিল্পকলা একাডেমি।

সংবাদচিত্র ডটকম/স্মরণীয় বরণীয়

প্রিন্ট করুন