সরকারি চাকরি পেতে কেউ কি নিজের মেয়েকে অস্বীকার করতে পারেন? বয়স কমাতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে তিনি বিয়ে করেছেন মাত্র সাত বছর বয়সে। বাবা হয়েছেন নয় বছর বয়সে।
এতো গেলে হিসেবের গড়মিল। কিন্তু সেই ব্যক্তির যদি দুটি জাতীয় পরিচয়পত্র থাকে এবং দুটিই যদি সচল থাকে তাহলে তাকে কি বলবেন? জাতীয় পরিচয়পত্র করতে তো আঙ্গুলের ছাপ লাগে, চোখের কর্নিয়ার ছাপ নেয়া হয়, তাহলে কিভাবে সম্ভব?
এমন সব তুঘলকি কাণ্ড করে বহাল তবিয়তে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন এক রোলার চালক। তার মাসিক বেতন ২০ হাজার টাকা। কিন্তু তার সম্পদ কোটি কোটি টাকার।
গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভা। এখানে একজন রোলার চালক আছেন, নাম সবুজ মিয়া। ২০২০ সালের আগস্ট মাসে তিনি শ্রীপুর পৌরসভায় নিয়োগ পান।
যে জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে তিনি চাকরি পেয়েছেন তাতে তার নাম সবুজ মিয়াই। জন্ম ১৯৯০ সালে। সেই হিসেবে তার বয়স এখন ৩২ বছর।
সবুজ মিয়া ১৯৯৭ সালে জহিরুল হক হিসেবে এক নারীকে বিয়ে করেন। তাদের সংসারে ১৯৯৯ সালে জন্ম নেয় এক মেয়ে।
পৌরসভায় জমা দেয়া জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী সবুজ মিয়া রুনা বেগমকে বিয়ে করেছেন সাত বছর বয়সে আর তার প্রথম সন্তান হয়েছে নয় বছরে।
২০০৪ সালে তাকে তালাক দেয়ার পর মেয়েকে কখনোই মায়ের সাথে দেখা করতে দেননি উল্টো মেয়ের সাথে দেখা করলে হত্যার হুমকিও দিয়েছেন বলে জানান রুনা বেগম।
মিথ্যা তথ্যে দেয়া চাকরি বাঁচাতে সবুজ মিয়া এখন নিজ সন্তানকেও অস্বীকার করছেন। যাতে পিতার পরিচয় নিয়ে সংকটে পরেছে মেয়েটি।
অনুসন্ধান করতে গিয়ে পাওয়া যায় আরো অবাক করা তথ্য। এই সবুজ মিয়ার আরো একটি জাতীয় পরিচয়পত্র আছে। সেটি তিনি করেছিলেন জহিরুল হক নামে। জন্ম সাল ১৯৮০।
জাতীয় পরিচয়পত্র কর্তৃপক্ষের সাথে সেই এনআইডি নিয়ে যোগাযোগ করা হলে জানা যায় সম্প্রতি সেই জহিরুল হক নাম সংশোধন করে তিনি সবুজ মিয়া হয়েছেন।
এখন সবুজ মিয়া নামে তার দুটি জাতীয় পরিচয়পত্রই সচল রয়েছে। শ্রীপুরের ভোটার তালিকাতেও তার নাম জহিরুল হক।
ময়মনসিংহ গফরগাঁওয়ের কান্দিপাড়া আসকার আলী হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাসের সার্টিফিকেটেও তার নাম জহিরুল হক। দুটি এনআইডিতে নাম, পিতা মাতার নাম এক।
জাতীয় পরিচয়পত্রে আঙ্গুলের ছাপসহ বেশ কয়েকটি বায়োমেট্রিক ছাপ নেয়া হয়। তারপরও কিভাবে দুটি এনআইডি সক্রিয় থাকে সেই বিষয়ে কোন বক্তব্য দেয়নি নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ।
সবুজ মিয়া ২০০৪ সাল থেকে মাষ্টার রোলে শ্রীপুর পৌরসভায় চাকরী করেছেন। পেশায় পৌরসভার রোলার ড্রাইভার। মাসিক আয় সব মিলিয়ে ২০ হাজার টাকা।
কিন্তু এই আয়ে গাজীপুরে চারটি বাড়িসহ কয়েক কোটি টাকার মালিক সবুজ মিয়া। সরকারী চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী হয়েও স্ত্রী এবং বাবার নামে পৌরসভার ঠিকাদারিও করেন।
গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার মেয়রের কাছের লোক হিসেবে দাপট খাটিয়ে গড়েছেন বালুর ব্যবসাও। টাকার জোড়ে স্ত্রীকে বানিয়েছেন উপজেলা যুব মহিলা লীগের সভাপতি।
রোলার চালক হিসেবে গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভায় সবুজ মিয়ার চাকরী স্থায়ী হয়েছে মাত্র দুই বছর। এর আগে ১৬ বছর ছিলেন নাম মাত্র বেতন মাষ্টার রোলে।
সবচেয়ে মজার বিষয়, দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে রোলার চালকের চাকরি করলেও কবে তা চালিয়েছেন তা মনে করতে পারেন না তিনি।
কাজ না করেও তার দাপট পুরো পৌরসভায়। চতুর্থ শ্রেণির চাকরি করলেও বাবা আর স্ত্রীর নামে কোটি কোটি টাকার ঠিকাদারি করেন এই পৌরসভাতেই।
বর্তমানে মাত্র ২০ হাজার টাকা বেতন সবুজ মিয়ার। ২০১০ সালেও ছিল তার টানাটানির সংসার আর এখন শ্রীপুরেই চারটি বাড়ি, একটি প্রাইভেট কার।
একটি বাড়ি বহুতল হিসেবে নির্মাণাধীন। সবুজ মিয়ার দাবি এরমধ্যে একটি বাড়ির মালিক তার বোন জামাই। আর বোন জামাই বলছেন, বাড়ি তাকে সবুজ মিয়া কিনে দিয়েছেন।
সবুজ মিয়া এসব করতে পেরেছেন কারণ পৌর মেয়রের কাছের লোক তিনি। টাকার আর মেয়রের বদান্যতা কাজে লাগিয়ে স্ত্রী এখন উপজেলা মহিলা যুবলীগের সভাপতি।
শুধু মেয়র অফিসের ঠিকাদারি নয়, বালু ব্যবসাও এখন তার দখলে। এতো সম্পদের উৎস কি, এমন প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে পারেননি সবুজ মিয়া ও তার তৃতীয় স্ত্রী মৌসুমি সরকার।
এসব অনিয়ম আর দুর্নীতি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় এখন পর্যন্ত তিনজন স্থানীয় সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলাও করেছেন।
তবে যার দাপট খাটিয়ে এতকিছু সেই মেয়র বলছেন, সবুজ মিয়ার এত সম্পদের বিষয় তিনি জানেন না। সবুজ মিয়ার দাবি এখন পর্যন্ত কোনো তদন্তেই তার কিছু হয়নি সামনেও হবে না।
সংবাদচিত্র ডটকম/দূর্নীতি