স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে নিজেদের মেয়াদপূর্তির এক দিন আগে নুরুল হুদা কমিশন রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে জমকালো আয়োজনে জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মার্ট কার্ড দেয়। গত বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারির ওই অনুষ্ঠানে ১০০ জনকে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ খচিত বিশেষ স্মার্ট কার্ড দেয়া হয়। এ সময় বলা হয়, পর্যায়ক্রমে সব মুক্তিযোদ্ধাকে এ কার্ড দেয়া হবে। কিন্তু এরপর এক বছর পেরিয়ে গেলেও এই উদ্যোগের কোনো অগ্রগতি নেই।
মূলত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাসংক্রান্ত জটিলতা, মন্ত্রণালয় ও ইসির দূরত্ব এবং স্মার্ট কার্ড প্রিন্ট বন্ধ থাকায় বিষয়টি এখনো ঝুলে আছে। এদিকে তৎকালীন নির্বাচন কমিশন কেন এমন উদ্যোগ নিল, তা নিয়েও নারাজ খোদ মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী।
মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী মোজাম্মেল হক ক্ষোভ প্রকাশ করে বিদায়ী সিইসি নুরুল হুদাকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘উনি মুক্তিযোদ্ধাদের কার্ড দেয়ার কে? মুক্তিযোদ্ধা তালিকা করবে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়। নির্বাচন কমিশনের কাজ তো ভোটার তালিকা করা, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কী কাজ?’ খানিকটা উত্তেজিত হয়ে সরকারের এই জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী ‘এর বাইরে আমি আর কিছু বলতে চাই না’ বলে মোবাইল ফোনের লাইন কেটে দেন।
তবে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মার্ট কার্ড প্রদানে আন্তরিক। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বাকি মুক্তিযোদ্ধাদের স্মার্ট কার্ড দেয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে। কিন্তু সেটি কবে নাগাদ হবে, তা কেউ জানে না। প্রথম দফায় স্মার্ট কার্ড পাওয়া ১০০ মুক্তিযোদ্ধাকে নির্বাচন কমিশন আগ্রহী হয়ে বাছাই করলেও বাকি সবাইকে বিশেষ এই কার্ড পেতে আবেদন করতে হবে। আবেদনের পর মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে আইনি যাচাই (ভেটিং) হবে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা খচিত স্মার্ট কার্ড প্রদানে বর্তমান কমিশন আন্তরিক জানিয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান বলেন, ‘এ-সংক্রান্ত বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মিটিং করা হয়েছে এবং পরবর্তী সময়ে পত্র যোগাযোগের মাধ্যমে সম্মতি নেয়া হয়েছে। যথা শিগগিরই বীর মুক্তিযোদ্ধা খচিত স্মার্ট কার্ড প্রদানের ব্যাপারে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে মাঠ পর্যায়ে নির্বাচন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়ে হবে। সম্মানিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আবেদন প্রাপ্তিসাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে ভেটিং (আইনি যাচাই) হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মার্ট কার্ড প্রদান করা হবে।’
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, বিশেষ এই স্মার্ট কার্ডের চিপের নিচ দিয়ে লেখা থাকবে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’। স্মার্ট কার্ডে তিন স্তরের ২৫টি নিরাপত্তাবৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রথম স্তরের নিরাপত্তাবৈশিষ্ট্য খালি চোখে দেখা গেলেও দ্বিতীয় স্তরের বৈশিষ্ট্যগুলো দেখার জন্য প্রয়োজন হয় বিশেষ যন্ত্র। অন্যদিকে ল্যাবরেটরিতে ফরেনসিক টেস্টের মাধ্যমে শেষ পর্যায়ের নিরাপত্তাবৈশিষ্ট্য শনাক্ত করা যাবে।
মুক্তিযোদ্ধাদের নামের আগে ‘বীর’ শব্দটি ব্যবহারের বিধান করে ২০২০ সালে গেজেট প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। গেজেটে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট আইন, ২০১৮-এর ধারা ২(১১)-এ মুক্তিযোদ্ধাদের ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে গেজেটেড মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫৬০ জন।
জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের (এনআইডি) মহাপরিচালক এ কে এম হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমাদের স্মার্ট কার্ড প্রিন্টিং বন্ধ আছে। এটা ঠিক হলেই আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের আবেদন অনুযায়ী স্মার্ট কার্ড বিতরণ করব।’ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা কে করবে, এমন কারণে কার্ড দেয়া ঝুলে আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় ওপিনিয়ন (মতামত) দিয়েছে।’ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এ জন্য আবেদন করতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আবেদন অনুযায়ী আমরা ভেটিংয়ে পাঠাব তাদের কাছে (মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়)। যখন ওনারা শনাক্ত করে দেবেন, তখন আমরা স্মার্ট কার্ড দিয়ে দেব।’
কবে নাগাদ দেয়া শুরু হবে জানতে চাইলে এ কে এম হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। সার্ভারের পার্টস নষ্ট আছে। সেটা ঠিক হলেই যত দ্রুত সম্ভব দেয়ার চেষ্টা করব।’
২০০৭ সালে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকার কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে এনআইডি কার্যক্রম শুরু করে ইসি। এরপর বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ২০১১ সালে স্মার্ট কার্ড (আইডিইএ) প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। সেই প্রকল্প শেষ হলে ২০২০ সালে আইডিইএ-২ প্রকল্প হাতে নেয়া হয় সরকারি তহবিল থেকে। বর্তমানে এর অধীনে দেশের সব নাগরিককে স্মার্ট কার্ড সরবরাহের কার্যক্রম চলছে।
নির্বাচন কমিশনের আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহ্যান্সিং অ্যাকসেস টু সার্ভিসেস আইডিইএ (২য় পর্যায়) প্রকল্পের উপপরিচালক (কমিউনিকেশন) স্কোয়াড্রন লিডার শাহরিয়ার আলম দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় করবে না আমরা (নির্বাচন কমিশন) করব, এটা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়। এ জন্য কার্ডটা দেয়া হয়নি। বীর মুক্তিযোদ্ধা খচিত কার্ড বর্তমানে স্টপ আছে। আবার চালু করার চেষ্টা করছি।’
গত বছর ফেব্রুয়ারিতে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা, কমিশনার মাহবুব তালুকদার, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকসহ বীর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সদস্য, রাজনীতিবিদ, সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্য, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ দেশের ১০০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে এই বিশেষায়িত স্মার্ট কার্ড প্রদান করা হয়।
সে সময় প্রধান অতিথি আইনমন্ত্রীর কাছ থেকে শাহজাহান ওমর (বীর উত্তম), মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া (বীর বিক্রম), শাহজাহান সিদ্দিকী (বীর বিক্রম), খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী (বীর প্রতীক), শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক রানা দাশগুপ্ত, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, শেখ শহীদুল ইসলাম, জাফরুল্লাহ চৌধুরী, এস এম আনোয়ারা বেগম, শাহীন সামাদ, মো. রফিকুল আলম, রুহুল আমিন হাওলাদার, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, নাসির উদ্দিন ইউসুফ, রাশিদুল আলম, সৈয়দ হাসান ইমাম, লায়লা হাসান, সাবেক চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ স্মার্ট কার্ড গ্রহণ করেছিলেন।
সংবাদচিত্র ডটকম/জাতীয়