পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচীর ‘জনক’ বিজ্ঞানী ড. আব্দুল কাদির খান মারা গেছেন। দেশটির রাজধানী ইসলামাবাদে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বলে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে। খবর বিবিসি’র। ড. আব্দুল কাদির খান-এর বয়স হয়েছিলো ৮৫ বছর। তিনি বেশ কিছুদিন যাবত অসুস্থ ছিলেন।
রোববার (১০ অক্টোবর) সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ড. কাদির খানকে ফয়সাল মসজিদ চত্বরে দাফন করা হবে। তাঁর মৃত্যুতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান শোক প্রকাশ করেছেন। শোকবার্তায় তিনি বলেছেন, ড. আব্দুল কাদির খানকে পাকিস্তানের মানুষ ভালোবাসতো, কারণ তিনি দেশটিকে পারমানবিক শক্তিধর একটি দেশে রূপান্তর করেছিলেন, এবং তিনি ছিলেন পাকিস্তানের একজন জাতীয় বীর।
গত ২৬ অগাস্টের ড. আব্দুল কাদির খান করোনাভাইরাস আক্রান্ত হন। এরপর তাঁর স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি হতে থাকলে তাঁকে কাহুটা রিসার্চ ল্যাবরেটরি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর সুস্থ হয়ে তিনি বাড়ি ফিরেছিলেন, কিন্তু গত রোববার তাঁকে আবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
বিশ্বের প্রথম মুসলিম দেশ হিসেবে পাকিস্তানের পরমাণু বোমার অধিকারী হওয়ার পেছনে তাঁকে কৃতিত্ব দেয়া হয়। কিন্তু উত্তর কোরিয়া এবং ইরানের কাছে পরমাণু বোমার গোপন তথ্যাদি পাচারের অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
২০০৪ সালে ড. আব্দুল কাদির খান পারমানবিক প্রযুক্তি হস্তান্তর করছেন সন্দেহে গ্রেপ্তার হন, এবং এরপর পাঁচ বছর আটক ছিলেন। ২০০৯ সালে তার আটকাদেশ সরকার প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু এরপর তিনি আর কখনো জনসমক্ষে আসেননি। ধারণা করা হয়, তাঁকে নজরবন্দি করে রাখা হয়েছিলো।
১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল অবিভক্ত ভারতের ভোপালে জন্মগ্রহণ করেন ড. আব্দুল কাদির খান। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পরিবারের সংগে পাকিস্তানে চলে যান। করাচিতে পড়ালেখার পর উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি ইউরোপে যান। সেখানে ১৫ বছরের প্রবাস জীবনে তিনি টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্ট বার্লিন, নেদারল্যান্ডসের ইউনিভার্সিটি অব ডেলফ্ট এবং বেলজিয়ামের ইউনিভার্সিটি অব ল্যুভেন-এ পড়াশোনা করেন।
১৯৭৪ সালে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচী নিয়ে দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো’র সংগে যোগাযোগ হওয়ার পর ১৯৭৬ সালে পাকিস্তানে ফিরে আসেন ড. আব্দুল কাদির খান। ওই বছরই ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ল্যাবোরেটরিজ স্থাপন করেন। ১৯৮১ সালে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া-উল-হক ওই ল্যাবরেটরির নামকরণ করেন ড. আব্দুল কাদের খান-এর নামে। পাকিস্তানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচীতে এই ল্যাবরেটরি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
নিজের লেখা একটি প্যাম্ফলেটে ড. একিউ খান লিখেছিলেন, পাকিস্তানের পারমানবিক কর্মসূচীর ভিত্তি রচিত হয়েছিলো তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর হাতে এবং দেশটির পরবর্তী শাসকেরা সে কর্মসূচীকে সমর্থন করেছেন।
ড. আব্দুল কাদির খানকে পাকিস্তানের পারমানবিক কর্মসূচীর প্রাণপুরুষ বলা হয়। তিনি দীর্ঘদিন ওই কর্মসূচীর নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু ১৯৯৮ সালের মে মাসে ভারত পারমানবিক পরীক্ষা চালানোর পর পাকিস্তান যখন প্রথম সফল পারমানবিক পরীক্ষা চালায় তখন ড. কাদির খান বেলুচিস্তানের পাহাড়ে সে পরীক্ষা তদারক করেননি। বরং সেটি করেছিলেন পাকিস্তানের আণবিক শক্তি কমিশনের ড. সমর মুবারাকমান্দ।
২০০৪ সালে উত্তর কোরিয়া, ইরান এবং লিবিয়ার সংগে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির তথ্য পাচার করার অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে এক টিভি সাক্ষাৎকারে তিনি ওই অভিযোগ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ তাঁকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু ২০০৯ সাল পর্যন্ত তাঁকে অন্তরীণ রাখা হয়। ড. কাদির খান-এর বিরুদ্ধে ডাচ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চুরির অভিযোগেও উঠেছিলো। এজন্য তাঁর বিচারও হয়েছিলো। কিন্তু নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য এবং জার্মানির অধ্যাপকদের সুপারিশে নতুন করে তদন্তের পর সেই অভিযোগ থেকে মুক্তি পান ড. কাদির খান। পরবর্তীতে নেদারল্যান্ডসের সুপ্রিম কোর্ট আনুষ্ঠানিকভাবে ওই অভিযোগ থেকে তাঁকে মুক্তি দেয়।
সংবাদচিত্র/আন্তর্জাতিক