তারপর আরও এক ব্যাটসম্যান আউট। এক প্রান্তে টিকে থাকলেন শুধু শান্ত।
বাংলাদেশের লক্ষ্য মাত্র ১১৮ রানের হলেও মিরপুরের এই পিচে পাওয়ার প্লে-র পর রান তোলা যে কঠিন হবে, তা ইংল্যান্ডের ইনিংসই বুঝিয়ে দিয়েছিল। এর মধ্যেও বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের বেশ কয়েকজন উইকেট বিলিয়ে দিয়ে কাজটা আরও কঠিন করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এক প্রান্তে টিকে ছিলেন ২০২৩-এ এসে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়া নাজমুল হোসেন শান্ত।
শেষ পর্যন্ত শান্ত অপরাজিত ছিলেন ৪৬ রানে। তার ব্যাটে চড়ে আজ মিরপুরে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে ইংল্যান্ডকে ৪ উইকেট আর ৭ বল হাতে রেখে হারিয়েছে বাংলাদেশ। এক ম্যাচ হাতে রেখে সিরিজ জয়, তাতে রচিত হলো ইতিহাস। আগের ম্যাচে প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ডকে টি-টোয়েন্টিতে হারানোর স্বাদ পাওয়া বাংলাদেশ এই প্রথম ক্রিকেটের কোনো সংস্করণে দ্বিপাক্ষিক সিরিজে হারিয়েছে ইংলিশদের!
শান্তর পাশাপাশি এ জয়ে সবচেয়ে বড় অবদান মেহেদী হাসান মিরাজেরও। ইংল্যান্ডকে ১১৭ রানে অলআউট করার পথে মিরাজ মাত্র ১২ রানে নিয়েছেন ৪ উইকেট। এরপর ব্যাট হাতে শান্ত যখন সঙ্গী খুঁজে হয়রান, বাংলাদেশের যখন একটা জুটির দরকার, পাঁচে নেমে ১৬ বলে ২০ রানের আগ্রাসী ইনিংসে মিরপুর স্টেডিয়ামকে জাগিয়ে তোলেন মিরাজই।
ইংল্যান্ডের ইনিংস বুঝিয়ে দিয়েছিল, এই উইকেটে পাওয়ার প্লে-তে কিছু রান তুলতে পারলে পরে লক্ষ্য হিসাবে রেখে দেখেশুনে ব্যাটিং করা যাবে। বাংলাদেশ পরে ব্যাটিংয়ের সুবিধা পেয়েছে, তার ওপর লক্ষ্যও ছোট, টপ অর্ডারের দায়িত্ব ছিল উইকেট না বিলিয়ে দিয়ে পাওয়ার প্লে-তে কিছুটা এগিয়ে দিয়ে আসা।
শুরুটা খারাপ হয়নি বাংলাদেশের। তৃতীয় বলে উইকেটের পেছন দিয়ে রনি তালুকদারের চার মেরে শুরু, ছয় বল পর ওকসকে চার লিটনের। কিন্তু তার ছয় বল পর ছন্দপতন। স্যাম কারেনের বলে পুল করতে চেয়েছিলেন লিটন, কিন্তু ধীরগতির পিচে বলের গতি বুঝতে পারেননি, টাইমিং ঠিক হলো না। সল্টের সহজ ক্যাচের শিকার লিটনের রানখরা দীর্ঘায়িত হলো, আউট হলেন ৯ বলে ৯ রান করে।
পাওয়ার প্লে-র শেষ ওভারে রনি তালুকদারও ড্রেসিংরুমে। জফরা আর্চারের গতির কারণেই কি না, বারবার পিছিয়ে গিয়ে পেছনের পায়ে খেলছিলেন রনি। ষষ্ঠ ওভারের প্রথম বলটা মিড অনের ওপর দিয়ে মারতে চেয়েছিলেন রনি, কিন্তু আর্চারের একটু বেশি লাফিয়ে ওঠা বলে শটটা কিছুই হলো না। মঈন আলীর সহজ ক্যাচে পরিণত রনি ফিরলেন ১৪ বলে ৯ রান করে।
ওই ওভারেই আর্চারকে প্রথম বাউন্ডারি শান্তর, বাংলাদেশ পাওয়ার প্লে শেষ করল ২ উইকেটে ৩২ রান নিয়ে।
পাওয়ার প্লে শেষ, দুই উইকেটও নেই – বাংলাদেশের বাউন্ডারি শুকাবে অনুমিত ছিল। পাওয়ার প্লের পর প্রথম বাউন্ডারি এল দশম ওভারে, তা-ও আদিল রশিদকে মিড অনের ওপর দিয়ে তৌহিদ হৃদয়ের ঝুঁকিপূর্ণ শটে। তবে বাউন্ডারি তো এসেছে! এক বল পর আবার রশিদকে চার হৃদয়ের, এবারের এক্সট্রা কাভারে শটটা দারুণই হলো। এই দুই চার নিয়ে ইনিংসের অর্ধেক শেষে বাংলাদেশের রান ২ উইকেটে ৫৫। রানরেট ঠিকঠাকই ছিল – ৬০ বলে তখনো দরকার ৬৩ রান, জুটিও আস্তে আস্তে হচ্ছিল। বাংলাদেশ আবার আশায় বুক বেঁধেছে।
কিন্তু অভিষিক্ত রেহান আহমেদ বোলিংয়ে আসতেই আশার গুড়ে বালি। তার আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় বলেই উইকেট! যেন উইকেটটা বিলিয়ে দিয়ে এলেন হৃদয়। হাফ ভলি বলটাকে মাঠের যেকোনো প্রান্তে পাঠানোর সুযোগ ছিল, হৃদয় পাঠালেন পয়েন্টে ওকসের হাতে। তার ১৮ বলে ১৭ রানের ইনিংস শেষ, বাংলাদেশ আবার শঙ্কায়।
শঙ্কা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ ইনিংসে সবচেয়ে দারুণ সময়টা কেটেছে এরপর। ক্রিজে এলেন মিরাজ, শান্ত তখনো ২১ বলে ১৮ রানে অপরাজিত। প্রথমে কিছুক্ষণ দেখেশুনে খেলেছেন দুজন, তবে টানা তিন ওভারে ৫-৬ করে রানও নিয়েছেন। ১৩তম ওভার শেষেও বাংলাদেশের সমীকরণ – ৪২ বলে ৪৭ দরকার।
১৪তম ওভার শুরু হতে না হতেই সমীকরণ দাঁড়াল ৪১ বলে ৪১! রশিদকে অসাধারণ ইনসাইড-আউটে ছক্কা মিরাজের। ঘটনাবহুল এক ওভারের শুরু। তৃতীয় বলে শান্তর বিরুদ্ধে এলবিডাব্লিউর আপিল, আম্পায়ার আউট না দিলে রিভিউ নেয় ইংল্যান্ড। কিন্তু বল স্টাম্পের বাইরে পিচ করায় বেঁচে যান শান্ত। পঞ্চম বলে রশিদের দুর্দান্ত লেগ স্পিনে শান্ত তো শান্ত, উইকেটকিপার বাটলারও পরাস্ত হওয়ায় উল্টো বাই চার পেল বাংলাদেশ। অল্পের জন্য আরেকবার বেঁচে গেলেন শান্ত। রশিদের বলটা সামনের পা এগিয়ে নিয়ে খেলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বিশাল বাঁক খাওয়া বলটা স্টাম্পের ঠিক ওপর দিয়ে চলে গেল। বাটলারের তা ধরার সাধ্য ছিল না।
পরের ওভারটা হলো রানের ওভার। মঈনের ওভারের তৃতীয় বলে জোরাল সুইপে ছক্কা মিরাজের, এক বল পর পয়েন্ট দিয়ে স্কুপে চার শান্তর। পরপর দুই ওভারে ১২ রান করে পেল বাংলাদেশ। মিরাজের নেতৃত্বে মুহূর্তের এই ধাক্কায় ১৫ ওভার শেষে বাংলাদেশের রান দাঁড়ায় ৩ উইকেটে ৯৫, তখন আর ৩০ বলে ২৩ রান দরকার বাংলাদেশের। ম্যাচটা ওই দুই ওভারেই হেলে গেছে বাংলাদেশের দিকে।
এরপর আরও ধাক্কা এসেছে। ১৬তম ওভারের চতুর্থ বলে আর্চারকে পুল করতে গিয়ে টাইমিংয়ের ভুলে ক্যাচ আউট মিরাজ, পরের ছয় বলে স্কোরবোর্ডে ৩ রান যোগ হতেই মঈনের বলে ক্যাচ দিলেন সাকিবও। দলের রান তখন ১০০। ১৮তম ওভারের পঞ্চম বলে আর্চারের গতির ধাক্কায় স্টাম্প উপড়ে গেল আফিফেরও। একে একে ব্যাটসম্যানরা সব বিদায় নিচ্ছেন, শান্ত তখন এক প্রান্তে একা দাঁড়িয়ে।
১৮ ওভার শেষে বাংলাদেশের রান ৬ উইকেটে ১০৫, আফিফ আউট হওয়ার পর ক্রিজে এসেছিলেন তাসকিন। শান্ত তখন ৪৪ বলে ৩৯ রানে অপরাজিত।
এরপর ১৯তম ওভারে একটা ‘মহেন্দ্র সিং ধোনি’ চাল দিতে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ড অধিনায়ক বাটলার, কিন্তু হিসেবে বুঝি একটু গড়বড় হয়ে গেল। স্পিনার রেহান, পেসার ওকস ও কারেন – সবারই ওভার বাকি ছিল, কিন্তু বাটলার হঠাৎ ইনিংসে প্রথমবারের মতো বল তুলে দিলেন ক্রিস জর্ডানের হাতে।
তার প্রথম বলেই পুল করে চার শান্তর। তার পরের দুই বলে এল একটি ডাবল ও সিঙ্গেল। ম্যাচ আবার তখন হেলে পড়েছে বাংলাদেশের দিকে। কিন্তু তাসকিনের তর সইছিল না। পরপর দুই বলে দুই চারে সব সমীকরণ মিলিয়ে দিলেন। ইতিহাস গড়া হয়ে গেল বাংলাদেশের।
সংবাদচিত্র ডটকম/ক্রিকেট