‘রামপালে ইন্দোনেশিয়া বা অস্ট্রেলিয়া থেকে উন্নতমানের কয়লা আনা হবে এতে পরিবেশ দূষণ হবে না।’ অবশ্য পরিবেশবাদীরা বলছেন, ‘ক্লিন কোল’ বা ‘বিশুদ্ধ কয়লা’ বলে কিছু নেই। সব কয়লায় পরিবেশ দূষণ হবে।
আরও শঙ্কার বিষয় হলো, অস্ট্রেলিয়া বা ইন্দোনেশিয়া নয়, চলতি বছর চালু হতে যাওয়া এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রথম ধাপেই ৪ হাজার ৫০০ টন নিম্নমানের কয়লা আনা হচ্ছে ভারত থেকে। তবে ভারতীয় গণমাধ্যমে এই খবর প্রকাশের পর রামপালের কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘এই কয়লা পোড়ানোর জন্য নয়, কোল ইয়ার্ডের ফ্লোর করার জন্য আনা হচ্ছে।’ তবে ভারত থেকে কয়লা আসার খবর আবার ভাবিয়ে তুলেছে পরিবেশবাদীদের।
এই বিষয়ে সোমবার (৫ জুলাই) ‘রামপালমুখী ভারতীয় কয়লা, বিপদাপন্ন সুন্দরবন ও ইউনেস্কো বিশ্ব-ঐতিহ্য কমিটির আসন্ন সভা” শীর্ষক ভার্চুয়াল এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপা। এতে ভারতের কয়লার ক্ষতিকর দিক তুলে ধরেন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জ্বালানি এবং পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। দাবি তোলা হয় রামপাল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিলের।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সভাপতি সুলতানা কামালের সভাপতিত্বে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে ক্যালিফোর্নিয়া (যুক্তরাষ্ট্র) থেকে অংশ নেন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশলী ড. রনজিত শাহু। তিনি বলেন, ‘রামপালের পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন-এ বলা হয়েছিল এখানে কয়লা আসবে ইন্দোনেশিয়া বা অস্ট্রেলিয়া থেকে। কোথাও ভারতীয় কয়লার কথা লেখা ছিলো না। ভারতের কয়লার মান খুব খারাপ। ভারতের ধানবাদ থেকে যে কয়লা আসবে তাতে এতো নিম্নমানের খনিজ মেশানো থাকে যে এটি পোড়ালে দূষণ হবেই৷ বায়ু ও পানি দূষণ তো হবেই।’
‘ক্লিন কোল’ বা ‘বিশুদ্ধ কয়লা’ বলে আসলে কিছু নেই উল্লেখ করে ড. রনজিত শাহু বলেন, ‘কয়লা পোড়ালে দূষণ হবেই। কাজেই এটি একটি বড় মিথ্যা। যতই ব্যবস্থা নেয়া হোক না কেনো।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার বলছে, ভারত থেকে আনা কয়লা পোড়ানো হবে না। কোল ইয়ার্ডে ৪ হাজার ৫০০ টন কয়লা লাগবে। তারা বলেনি এটাই শেষ। তারা এমনভাবে বলছে তাতে মনে হচ্ছে প্রথমে ৪ হাজার ৫০০ টন কয়লা আসছে। এদিকে ভারতের পত্রিকাগুলো বলছে ২০ হাজার টন কয়লা লাগবে। এটাও চিন্তার বিষয়।’
তাছাড়া কয়লা না পোড়ালেও পরিবহনের সময় যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তাতেও নদীর দূষণ হবে বলে জানান এই বিশেষজ্ঞ।
সংবাদ সম্মেলনে বাপা’র সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল একটি প্রবন্ধ তুলে ধরেন। প্রবন্ধ উপস্থাপনায় তিনি বলেন, আমরা এতো প্রতিবাদ করার পরও রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ চালিয়েই যাচ্ছে। ইউনেস্কোর কথাও শুনছে না সরকার। ইউনেস্কোর জন্য সুন্দরবন বিষয়ে সিইজিআইএসের (সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল এন্ড জিওগ্রাফিক ইনফর্মেশন সার্ভিসেস) মাধ্যমে যে প্রতিবেদন করা হবে তার কতোখানি নিরপেক্ষ হবে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ সেখানে কেবল সরকারি লোক আছে।
শুধু রামপাল নয়, তালতলী ও কলাপাড়ায় যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে তাও সুন্দরবনের ক্ষতির কারণ হতে পারে কি না তাও ইউনেস্কোর দেখা উচিত। রামপাল কর্তৃপক্ষ বলছে, কোল ইয়ার্ডের ফ্লোর করার জন্য কয়লা আনা হচ্ছে। আসলে ইয়ার্ড করতে কত কয়লা লাগতে পারে সে বিষয়ে পরিষ্কার হওয়া দরকার।
তিনি বলেন, ‘সরকার মুখে বলছে তারা সুন্দরবনের ক্ষতি হোক তা চায় না। কিন্তু শুধু মুখে বললেই হবে না, কাজের ক্ষেত্রেও এই জিনিস দেখাতে হবে।’ এই সময় তিনি সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কয়লা নিয়ে আসার বিরোধিতা করে অবিলম্বে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করার দাবি তোলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম. এম. আকাশ বলেন, ‘সরকার অনেকগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল করেছে। রামপালের ক্ষেত্রে সরকার কোনো যুক্তি মানছে না। এটা কেনো বন্ধ করা যাচ্ছে না? নেপাল ও ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেই বিদ্যুৎ এলেই তো আমরা আরও বিদ্যুৎ পাবো। এক সময় না এক সময় এই কয়লা কেন্দ্র বন্ধ করতেই হবে। তাহলে যে কেন্দ্র বন্ধ করতেই হবে সেটি এখন কেনো করতেই হবে। এটি এখনই বাদ দেয়া উচিত।’
নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী মানবাধিকার কর্মী, খুশী কবির বলেন, ‘এমন কয়লা আনা হচ্ছে যে কয়লা ভারতের কেন্দ্রেও ব্যবহার করা হয় না। এই ক্ষতি হবে অপূরণীয়। আরও বেশি প্রকৃতিকে বিনষ্ট করবে। কয়েক বছরের মধ্যে কয়লা বিদ্যুৎ বন্ধ করার বিষয়ে পৃথিবী এখন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এটি আনার কোনো যুক্তি নেই। অস্বচ্ছতার একটিই কারণ হতে পারে‑ অন্য কারো স্বার্থ দেখা হচ্ছে, দেশের স্বার্থ না।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনেকেই বলেন যারা প্রতিবাদ করছেন তারা সঠিক তথ্য জানে না। তাহলে সঠিক তথ্য কি? নদী দিয়ে যে কয়লা আনা-নেয়া করবে তাতে নদীর দূষণ হবে না এই নিশ্চয়তা কে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোতে যে এই নিয়ে আলোচনা হচ্ছে তারাও কি কিছু জানে না? সরকার তথ্যগুলো সঠিকভাবে দিচ্ছে না। আমরা তথ্য চাইলে দেখছি যে একেকবার একেক রকম তথ্য দেয়া হয়।’
পরিবেশবিদ আইনজীবী সমিতি (বেলা) এর প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘যেখানে আমাদের এখনই ওভার ক্যাপাসিটি হয়ে গেছি, সেখানে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কেনো দরকার। উপরন্তু বসে থাকা এই এই কেন্দ্রের জন্য আমাদের টাকাই ট্যাক্স থেকে কেটে নেয়া হবে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র আসলে বাতিল করা হবে না। কেবল রাজনৈতিক কারণে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র করছে। যা এক সময় আর কোনো কাজে লাগবে না। নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিদ্যুৎ বাড়ান। বাংলাদেশ চাইলেই নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিদ্যুৎ বাড়াতে পারে। এতে বাংলাদেশ প্রশংসিত হবে। আবার ততোটাই নিন্দিত হবে বাংলাদেশে যদি এই ওভার ক্যাপাসিটির পর রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা হয়।
আমরা বলছি, সরকার শুনছে না। তারা না শুনলে এটি ইতিহাস হয়ে থাকবে। ইআইএ-টা এখন আর আগের মতো নেই। সম্প্রতি সরকার বলেছে, ইআইএ দেরি হলে কাজ শুরু করে দিতে। তাহলে ইআইএ-র মূল্য থাকলো কোথায়। সরকার জনমত উপেক্ষা করে এসব করে যাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন রেজওয়ানা হাসান।’
তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির অন্যতম সংগঠক রুহীন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘রামপালের কারণে ইউনেস্কো যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয় সেটি পুরো দেশের জন্য ক্ষতিকর হবে। আর সরকার যেসব কথা বলছে তার কোনটিই বাস্তবে পালন করা হয় না। ধন্যবাদ জানাই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করেছে বলে। কিন্তু কেনো বাদ দিলো তা স্পষ্ট নয়। দশটার সঙ্গে মাতারবাড়ি, রামপাল প্রকল্প বাতিল করেন। এসব প্রকল্পে বন্ধুত্বের কথা বলা হচ্ছে, সুন্দরবনের ক্ষতি হলে এই বন্ধুত্ব নষ্ট হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর সহ-সভাপতি রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, ‘আমরা উন্নয়নবিরোধী নই। যে কেন্দ্র এক সময় বন্ধ করতেই হবেই সেই কেন্দ্রের পেছনে কেন টাকা খরচ করা হবে। সাধারণ মানুষও বোঝে রামপালের কারণে নদীর ক্ষতি হচ্ছে। আমাদের ঐতিহ্য রক্ষার অনীহাও এই ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা। আমাদের ঐতিহ্য রক্ষা করতে হলে সবাইকে নিয়ে বড় আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর নির্বাহী সহ-সভাপতি এবং সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ডা. মো. আব্দুল মতিন বলেন, ‘রামপাল এলাকার মানুষ ছাড়া বাইরে সবাই বুঝতে পারেন না কি ক্ষতি হতে পারে! স্থানীয় আন্দোলনকারীরা অনেক বিপদে আছে। তাদের পাশে দেশের মানুষকে দাঁড়াতে হবে। আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। আন্দোলন ধরে রাখতে হবে। দেশজুড়ে ছড়াতে হবে এই আন্দোলন। নাহলে এই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করতে পারবো না।’
সংবাদচিত্র/জাতীয়/করিম রেজা